রায়পুরে সাবেক এমপি নয়নের ‘একক রাজত্ব’ তিন বছরেই হয়ে ওঠেন পুরো জেলার নিয়ন্ত্রক

রায়পুর লক্ষ্মীপুর

 

দিগন্তের আলো ডেস্ক :-

লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদর একাংশ) আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন মাত্র ৩ বছরেই হয়ে ওঠেন পুরো জেলার নিয়ন্ত্রক। বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ, সরকারি অফিসের দরপত্র, চাঁদাবাজি এবং মনোনয়ন বাণিজ্যসহ সবকিছুতেই ছিল নয়নের নিয়ন্ত্রণ।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত নিজের ‘রাজত্ব’ ঠিক রাখতে বহুস্তর বিপণন ব্যবসার আদলে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের বসিয়েছিলেন নয়ন।

লক্ষ্মীপুরের সাধারণ মানুষ বলছেন, মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতের কারাগারে বন্দি কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ায় ভাগ্য খুলেছে নয়নের।

এতে শূন্য হওয়া লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনের উপনির্বাচনে ২০২১ সালের ২৮ জুন জয়ী হওয়ার পর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক এবং এমপি পদের জোরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেছেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও তিনি এমপি হন। দলের নেতাদের অভিযোগ, বিরোধী দলের মতো নিজ দলের নেতাকর্মীরাও তার কাছে জিম্মি ছিলেন।

সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান নয়নসহ তার অনুসারীরা। ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুটি মামলাও করা হয়েছে। নয়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে ৩ অক্টোবর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক জানায়, নয়ন ২০২১ সালে নির্বাচনি হলফনামায় বছরে ৩৬ লাখ ১০ হাজার ২৯০ টাকা আয় এবং ১ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৮ টাকার সম্পদ দেখিয়েছিলেন। তবে ঘোষিত সম্পদের চেয়ে তার কয়েক গুণ বেশি সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর মহিলা কলেজ রোডের ১০ শতাংশ জমিতে পাঁচতলা ভবন, ওই এলাকায় ৪০-৫০ শতাংশ জমি এবং ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্ল্যাট থাকার তথ্য মিলেছে।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ বিভিন্ন স্থানের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৩-১৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই বছরই এক লাফে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এখনও তিনি ওই পদেই বহাল আছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যবসায়ী কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল। আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, পাপুলকে প্রার্থী ও বিজয়ী করার নেপথ্যে ছিলেন এই অ্যাডভোকেট নয়ন। এজন্য তিনি বড় অঙ্কের অর্থ পেয়েছিলেন। পাপুল কুয়েতের কারাগারে বন্দি হলে নয়নের এমপি হওয়ার দরজা খুলে যায়। উপনির্বাচনে পাপুলের স্ত্রী কাজী সেলিনা ইসলাম প্রার্থী হলেও তাকে প্রচারণার মাঠে নামতে দেয়নি নয়নের সমর্থকরা।

এমপি হওয়ার আগে থেকেই নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল নয়নের বিরুদ্ধে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিয়োগ প্রত্যাশীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকার একটি অংশ পেতেন সাবেক এমপি নয়ন।

কয়েকজন শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মী এ প্রতিবেদককে বলেন, তারা চাকরির জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। আরও কয়েকজনকে দিতে হয়েছে। শুনেছেন টাকার একটি অংশ এমপি পেয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেতে প্রার্থীকে সর্বনিু ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।

নয়নের চাঁদাবাজি, মনোনয়ন-বাণিজ্য : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১০-১২ জন চালক জানান, জেলায় ১৫ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। প্রতিটি অটোরিকশা সড়কে নামার আগে চাঁদা দিতে হয়েছে চার-পাঁচ হাজার টাকা করে। এছাড়া প্রতি মাসে একেকটি অটোরিকশাকে সাড়ে চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই চাঁদাবাজির মূলে ছিলেন কুলি চৌধুরী। তিনি নয়নের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসাবে পরিচিত এবং চাঁদার বড় অংশ যেত তার কোষাগারে। এ খাতে বছরে চাঁদাবাজি হতো ২০ কোটি টাকা।

কুলি চৌধুরীর ছেলে সাইফুল ইসলাম রকি ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। তিনিও এখন আত্মগোপনে। রায়পুরের ব্যবসায়ী সাইফুদ্দিনসহ কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী জানান, এমপি নয়নের ঘনিষ্ঠ রায়পুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজি জামসেদ কবির বাকী বিল্লাহর বাড়ির পাশে সাইফুদ্দিন নামের এক ব্যক্তির দোকান দখল করেছেন। এমপি নয়নের ভয়ে সাইফুদ্দিন মামলা করতে পারেননি।

তবে বাকি বিল্লাহর দাবি, সাইফুদ্দিনের বড় ভাই খোকনের কাছ থেকে জমি কিনে অফিস ও ওষুধের দোকান দিয়েছে। সেখানে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, সাবরেজিস্ট্রি অফিসের চাঁদা, সালিস-বাণিজ্য, বিভিন্ন দপ্তরে চাঁদাবাজির পরিকল্পনা করা হতো। এ অভিযোগও অবশ্য অস্বীকার করেছেন বাকি বিল্লাহ।

কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, জেলার পাঁচ উপজেলা পরিষদ, ৫৮টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান, চারটি পৌরসভায় মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থী নির্ধারণ করে দিতেন এমপি নয়ন। এই মনোনয়ন দেওয়া হতো টাকার বিনিময়ে। ইউপি বা উপজেলায় নৌকা প্রতীক পেতে দিতে হতো কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে এই অঙ্ক কম-বেশি ছিল।

২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপির চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রশিদ মোল্লা বলেন, বেশি টাকা না দেওয়ায় তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। কে টাকা নিয়েছেন জানতে চাইলে বিষয়টি তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান।

তবে স্থানীয় একজন জানান, শুনেছেন রশিদ মোল্লা নৌকা প্রতীক পেতে সাবেক এমপি নয়নকে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তবে তিনি বেশি টাকা নিয়ে অন্যজনকে মনোনয়নের ব্যবস্থা করেন।

কমলনগরের চরলরেন্স ইউপির চেয়ারম্যান প্রার্থী ইছমাইল হোসেন জানান, টাকা দিয়েও তিনি মনোনয়ন পাননি। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির কাছে অভিযোগও দিয়েছেন। জেলার স্থানীয় সব নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়েই এমন অভিযোগ রয়েছে। রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সাবেক মেয়র হাজি ইসমাইল হোসেন খোকন বলেন, নয়নের কাছে দলীয় নেতাকর্মীরাও জিম্মি ছিলেন। নয়ন ও তার আত্মীয় ছাড়া দলের কোনো নেতাকর্মী মূল্যায়ন তার কাছে ছিল না। মনোনয়ন-বাণিজ্য ছিল তার অনৈতিক আয়ের প্রধান উৎস।

দলকে আত্মীয়করণ ও সঙ্গী তাহের পরিবার:

এক সময় লক্ষ্মীপুর চলত প্রয়াত মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তাহেরের ইশারায়। তাহেরের মৃত্যুর পর এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় নয়নের হাতে। তবে আত্মীয় হওয়ায় তাহের পরিবারকেও তিনি সঙ্গে রাখেন। তাহেরের মেজ ছেলে সদ্য অপসারিত সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাউদ্দিন টিপু তার মামাতো বোনের স্বামী।

অভিযোগ রয়েছে, সদর উপজেলায় সব চাঁদাবাজি এবং টেন্ডার-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে ছিল টিপু। তার ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ পুলিশের ওপর হামলার মামলাও রয়েছে। টিপু বর্তমানে সৌদি আরব অবস্থানে।

রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ নয়নের ভগ্নিপতি। নয়নের মামা হুমায়ুন কবীর পাটোয়ারী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং চররুহিতা ইউপির চেয়ারম্যান। শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় হুমায়ুন বর্তমানে কারাগারে আছেন।

রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১০নং রায়পুর ইউপির চেয়ারম্যান শফিউল আজম চৌধুরী (সুমন) নয়নের শ্যালক। সুমনের নীরব অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল পুরো ইউনিয়নসহ আশপাশের বাসিন্দারা। তবে সুমন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এই তিন আত্মীয়ের মাধ্যমে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে সবকিছুতে ছিল নয়নের নিয়ন্ত্রণে।

নয়নের স্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী লুবনা চৌধুরীর বিরুদ্ধেও স্বামীর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে। নয়ন ও টিপুর বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। ২০২২ সালে লক্ষ্মীপুরে জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম খুনের ঘটনায়ও নয়নের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। নিহত রাকিবের বাবা রফিক উল্যাহ জোড়া খুন মামলার প্রধান আসামি আবুল কাশেম জিহাদীর সঙ্গে ঘটনার ৭ দিন আগে নয়ন বৈঠক করেছেন বলে অভিযোগ করেন।

সরকার পতনের পর নয়ন আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি। টিপুসহ অভিযোগ ওঠা অন্যরাও আত্মগোপনে (দেশের বাহিরে) রয়েছেন।

জেলা যুবদলের সভাপতি রেজাউল করিম লিটন বলেন, নয়ন ও সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা হতো। তাদের অত্যাচারে ১৫ বছর বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী ছিলেন ঘরছাড়া। প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের পাশাপাশি মামলা ও হামলাসহ কারাগারে যেতে হতো। পুলিশ ওই দুজনকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি।

জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মাওলানা ফারুক হোসাইন নুরনবী বলেন, নয়নের নিয়ন্ত্রণে ছিল পুরো লক্ষ্মীপুর জেলা। অ্যাডভোকেট নয়ন ও সালাহ উদ্দিন টিপু শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন। তাদের আয়ের উৎস ছিল নিয়োগ, টেন্ডার, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, প্রতিটি হত্যা ও সংঘর্ষের ঘটনার তদন্ত করে বিচার করা হবে। অপরাধী যতই বড় হোক, কেউ ছাড় পাবেন না।

সুত্র :- সাংবাদিক তাবারক হোসেন আজাদ ভাই :- যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *