দিগন্তের আলো ডেস্ক :-
দলীয় নির্দেশনা ভঙ্গ করে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাঁচজন চেয়ারম্যান ও চারজন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করেছেন সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খান। ওই বৈঠকে অলিখিত কাগজে প্রার্থীদের সই, চেয়ারম্যান পদে ‘৩ কোটি টাকা দাম উঠানো’ ও একক প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নানা সমালোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এমপি আনোয়ার খান এলাকায় সর্বোচ্চ প্রভাব দেখান বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে এমপি-মন্ত্রীদের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হস্তক্ষেপ-প্রভাব বিস্তার না করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার নির্দেশ ও বিবৃতি দিয়েছেন। এরপরও প্রার্থীদের নিয়ে এমপি আনোয়ার খানের সমঝোতা বৈঠক ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। আর উপজেলা নির্বাচনে এমপির হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তার বড় ভাই চেয়ারম্যান প্রার্থী আখতার হোসেন খান ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তাকে নির্বাচন থেকে এমপি ও তার লোকজন চাপ দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। ওই স্ট্যাটাসে একাধিক প্রার্থী ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। যদিও পরে তিনি স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলেন।
জানা গেছে, বৈঠকে একক প্রার্থী হিসেব সমর্থন পাওয়া ব্যক্তি হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দেওয়ান বাচ্চু। তিনি বর্তমান উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। বাচ্চুর ছোট ভাই ফয়সাল দেওয়ান জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম হত্যা মামলার তিন নম্বর আসামি। উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে গত বছর ৫ ডিসেম্বর ফয়সাল মুক্তি পান
প্রত্যক্ষদর্শী ও দলীয় সূত্র জানায়, এমপি আনোয়ার খান গত রোববার (১৪ এপ্রিল) সন্ধ্যায় রামগঞ্জ শহরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে দলের সিনিয়র নেতা ও উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের ডাকেন। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা জড়ো হতে থাকেন। রাত ৮টার দিকে এমপি সেখানে আসেন। একক প্রার্থীর করার ‘স্বার্থে’ এমপি সেখানে উপস্থিত ৯ প্রার্থীর কাছ থেকে অলিখিত কাগজে সই নেন। একপর্যায়ে যারা প্রার্থী নন এমন ছয়জন নেতাকে দিয়ে ‘বোর্ড’ গঠন করেন এমপি। তারা হলেন- আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সাত্তার, বেলাল আহমেদ, এম এ মমিন পাটওয়ারী, সফি উল্যা, শামছুদ্দিন ও সফিক মিয়া। পরে এমপি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা একে একে প্রার্থীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে কথা বলেন। কে কত টাকা ব্যয় করতে পারবেন তা নিয়ে চলে খোলামেলা আলোচনা। পরে চেয়ারম্যান প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দেওয়ান বাচ্চু ‘৩ কোটি টাকা’ ব্যয় করবেন জানালে তাকে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়।
বৈঠকে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আ ক ম রুহুল আমিন, শহিদ উল্যা, নুরুল ইসলাম ও তাহসান আহমেদ রাসল। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রাকিবুল হাসান মাসুদ, মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ভূঁইয়া, শুরাইয়া আক্তার শিউলি সভায় ছিলেন। রাত ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত টানা এ
উল্লেখ্য, চেয়ারম্যান প্রার্থী ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি ইমতিয়াজ আরাফাত এবং এমপি আনোয়ার খানের বড় ভাই আখতার হোসেন খান উপস্থিত ছিলেন না। ইমতিয়াজকে ডাকাও হয়নি বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক সমঝোতা বৈঠকে অংশ নেওয়া তিনজন ইউপি চেয়ারম্যান ও চারজন আওয়ামী লীগ নেতা জানিয়েছেন, এমপি একক প্রার্থী দেবেন বলেই উপস্থিত ৯ প্রার্থীর কাছ থেকে অলিখিত কাগজে সই নেন। সেখানে দেওয়ান বাচ্চু সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা খরচ করবেন বলে জানান। এতে তাকে একক প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত দেন এমপি। এ সময় সোহেল রানাকে ভাইস চেয়ারম্যান ও সুরইয়া আক্তার শিউলিকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এমপি স্থানীয়ভাবে সর্বোচ্চ প্রভাব খাটান।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল গণমাধ্যমকে বলেন, এমপি অলিখিত কাগজে আমাদের পাঁচ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সই নিয়েছেন। এটি দলীয় নির্বাচনী নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নির্বাচন করলে কত টাকা খরচ করতে পারব তারা জানতে চাইলে আমি দেড় কোটি টাকা বলেছি।
আনোয়ার খান এমপির বড় ভাই মো. আখতার হোসেন খান বলেন, এমপি নির্বাচনের প্রার্থিতা নিয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। তার লোকজনের হুমকির মুখে আমি এলাকায় যেতে পারছি না।
ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান মাসুদ গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে আমাকে ১০ লাখ টাকা দেবে বলা হয়েছে। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। পরীক্ষিত সাবেক তিন ছাত্রনেতা প্রার্থী থাকার পরও এমপি পদবিহীন টাকাওয়ালা একজনকে ‘কথিত সমর্থন’ দিয়েছেন।
বৈঠকে একক প্রার্থী হিসেবে সমর্থন পাওয়া দেলোয়ার হোসেন দেওয়ান বাচ্চু বলেন, এমপির সঙ্গে করা বৈঠক প্রার্থীদের ‘সমঝোতার’ ছিল না। ৫-৬ জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা নির্বাচনের বিষয়টি উঠিয়েছেন। তখন এমপি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না বলে জানান। ওই সময়ই বার্ধক্যজনিত কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ ক ম রুহুল আমিন এবার নির্বাচনে দাঁড়াবেন না বলে মত প্রকাশ করেন। সবাই একসঙ্গে ভোট করলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে। এতে অন্য প্রার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে আমাকে সমর্থন দেওয়া হয়। ৩ কোটি টাকার ঘটনাটি বিভ্রান্তকর তথ্য। এত টাকা খরচ করার সামর্থ্যও আমার নেই।
রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ ক ম রুহুল আমিন বলেন, আমি প্রার্থী ছিলাম। দলের নেতাকর্মীদের সিদ্ধান্তে সরে দাঁড়িয়েছে। বৈঠকে টাকার ঘটনা নিয়ে অভিযোগটি বিভ্রান্তিকর তথ্য। তবে ভোট করতে টাকা লাগে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভোটের মাঠে টাকা খরচ হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনোয়ার হোসেন খান এমপির মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে এমপির স্থানীয় সমন্বয়কারী রামগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীদের অবস্থানসহ আর্থিক অবস্থা ও সক্ষমতাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক অলোচনা হয়েছে। এটি দলের আনুষ্ঠানিক কোনো সভা ছিল না। ঘরোয়া আলোচনা হয়েছে। কাউকে চাপিয়ে দেওয়া বা বাধ্য করা হয়নি।
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, রামগঞ্জ থেকে কয়েকজন আমাকে জানিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান পদ নাকি ৩ কোটি টাকা উঠেছে। দল থেকে একক কোনো প্রার্থী ঘোষণা বা সমর্থন দেওয়ার সুযোগ নেই। সমঝোতা বৈঠক করে আনোয়ার খান দলের নির্দেশনা ভঙ্গ করেছেন। ঘটনাটি কেন্দ্রে জানানো হবে।
প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রামগঞ্জে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।