‘শুধু শেখ হাসিনাকেই ম্যানেজ করতে পারেনি’—রিমান্ডে পাপিয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য

অপরাদ

 

দিগন্তের আলো ডেস্ক :
পাপিয়া-মফিজুর দম্পতির প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ ও অনৈতিক কাজে বাধ্য হওয়া মেয়েরা ‘মুখ খুলতে’ শুরু করেছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর পাপিয়া দম্পতির প্রতারণার শিকার মেয়েরা পাপিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এরইমধ্যে বিমানবন্দর থানায় পাপিয়া দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিলেন এক ব্যবসায়ী। সেখানে পাপিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তবে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তরের কারণে বিমানবন্দর থানা পুলিশ এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। অন্যদিকে গতকাল শুক্রবার দুপুরে সাভারের আশুলিয়ার গেরুয়া বাজার এলাকায় দারুল উলুম মাবিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার একটি ভবন উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, যুবলীগ নেত্রী পাপিয়ার সঙ্গে যারা অপরাধ করেছেন তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। যারাই অপরাধে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

পাপিয়া ও তার সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, রিমান্ডে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করছেন। পাপিয়ার কাছ থেকে জব্দকৃত মোবাইলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি(পাপিয়া) জানিয়েছেন, শুধু শেখ হাসিনাকেই ম্যানেজ করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সবাকেই ম্যানেজ করা যায়। সবার সাথেই তার সর্ম্পক রয়েছে। বড় অংকের টাকা খরচ করে একাধিকবার চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে সফল হয়নি বলে জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া স্বীকার করেছেন বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অনৈতিক কাজের মাধ্যমে পাপিয়া শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। এছাড়া দুর্নীতিবাজ আমলা ও বিভিন্ন সংস্থার কথিপয় কর্মকর্তার সাথে পাপিয়ার নিয়মিত হোয়াটসঅ্যপের মেসেজ ও কল যোগাযোগ করার তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, হোয়াটসঅ্যপের মেসেজ ও ভাইবারের মেসেজে নিয়মিত পাপিয়ার সাথে যোগাযোগ ছিল এমন শতাধিক আমলা, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সদ্য বিপুল টাকার মালিক বনে যাওয়া রাজনৈতিক নেতা-ব্যবসায়ীর সম্পর্কে তথ্য পেয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। আমলা ও প্রশাসনের এসব কর্তা ব্যক্তিদের মদদে রাতারাতি প্রভাবশালী হয়ে উঠে পাপিয়া। একই সাথে বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে অনৈতিক কর্মকান্ডের। আর এর বিনিময়ে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।

পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন একটি সূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া ও তার স্বামী জানিয়েছেন, ওয়েস্টিন হোটেলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চেয়েও বেশি যাতায়াত ছিল বিভিণœ সংস্থা, অধিদফতর, প্রকল্প পরিচালকদের মতো উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের। প্রকল্পের ঠিকাদারি টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য প্রথমে ব্যবসায়ীরা পাপিয়ার সাথে যোগাযোগ করতো। এর পর কাজ পেলে সেখান থেকে মোটা অংকের কমিশন দেয়া হতো তাকে। শুধু তাই নয়, পাপিয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক রাখতো আমলাদের বশে আনার জন্য এবং রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ধণাঢ্য ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতো।

বিমানবন্দর থানার ওসি ফরমান আলী সাংবাদিকদের বলেন, টুকু নামে এক ব্যক্তি পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে এসেছিলেন। ঘটনা শোনার পর পাপিয়া ও তার স্বামীকে মুখোমুখি করা হয়েছিল। তারা প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। মামলা করলে ঘটনা যেখানে ঘটেছে সেই নরসিংদী এলাকায় মামলা করতে হবে, এ কথা বলে ওই ব্যক্তিকে বিদায় দিয়েছি। মামলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। পুরো বিষয়টি ডিবি দেখভাল করবে।

অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পাপিয়ার বিরুদ্ধে যেকেনো ভুক্তভোগী অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ পেলে সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখে জড়িত প্রমাণ পেলে পাপিয়া দম্পতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পাপিয়া দম্পতির প্রতারণার শিকার ওই ব্যবসায়ী তপন তালুকদার টুকু। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচ মাস আগে আমি ঢাকা থেকে নরসিংদীতে এক অনুষ্ঠানে বন্ধুর বাড়িতে যাই। সেখানে পাপিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। অনুষ্ঠান শেষে পাপিয়া আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে কম বয়সী ৪ জন সুন্দরী তরুণীকে তারা আমার সামনে নিয়ে আসে। এরপর জোর করে তাদের সঙ্গে আমার অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে।

তিনি আরও বলেন, এরপর আমি চলে আসতে চাইলে পাপিয়ার স্বামী মফিজুর বলেন, এখন তো যাওয়া যাবে না। আপনি তো আমার মেয়েদের সঙ্গে খারাপ কাজ করেছেন। এখন তারা আপনার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করবে। এ কথা বলে তারা কোন পুলিশকে যেন ফোন দিলেন। আসলে তারা পুলিশ ছিলো না, তাদেরই সাজানো কোনো ব্যক্তি ছিলো। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হলো, আমি আসতেছি। তবে পুলিশের কেউ আসেননি।

তিনি বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামী আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন, এখান থেকে পার পেতে হলে, আপনাকে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। নইলে এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে দেবো। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবো। আপনার নামে মানবপাচারের মামলা দেয়া হবে। পরে আমাকে মারধর করে তারা। মান-সম্মানের ভয়ে আমি তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার টাকা দেয়ার পরও তাতে মন গলেনি। এরপর আমাকে বাড়ির ছাদে তিনদিন আটকে রাখে। একপর্যায়ে ব্যাংকের মাধ্যমে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা দেয়ার পর তারা আামকে ছেড়ে দেয়।
পাপিয়ার গ্রেফতারের খবর শুনে আমি বিমানবন্দর থানায় যাই, ওসিকে ঘটনা খুলে বলি জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, পরে ওসি পাপিয়াকে থানা হাজত থেকে তার রুমে ডেকে আনেন। এ সময় পাপিয়াকে সালাম দিয়ে আমার ওপর নির্যাতনের ঘটনা বলি। তখন সে হাত জোর করে আমার কাছে ক্ষমা চায়। থানার ওসির সামনে বলেন, তার ভুল হয়ে গেছে। একজনের নির্দেশে তিনি ওটা করেছিলেন। আমার টাকাটা ফেরত দেবে। আমাকে বলেন, তুমি আইনের আশ্রয় নিও না।

এরপরও টাকা না পাওয়ায় গত বুধবার ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ফের থানায় গিয়ে ওসিকে বলি, আমার টাকা না দিলে আমি পাপিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করবো। তখন ওসি বলেন, আপনি মামলা দিলে নরসিংদীতে দিতে হবে। কারণ আপনার সঙ্গে ঘটনাটি সেখানে ঘটেছে। পরে ওসির রুমে পাপিয়ার স্বামী সুমনকে ডাকা হলে সুমন হুমকি দিয়ে বলেন, আপনার টাকা দেবো না, যা করার করেন। আমাদের নামে আপনি কী মামলা দেবেন? বড়জোর প্রতারণার মামলা দেবেন। এ মামলায় দুই মাসের বেশি জেল হবে না। অস্ত্র মামলা খেয়েছি। তাতেই ভয় পাচ্ছি না। আর প্রতারণার মামলায় কী হবে। ব্যবসায়ী তপন তালুকদার টুকু আরো বলেন, প্রয়োজনে আমি আদালতের আশ্রয় নেবো। পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করবো। ওদের শাস্তি চাই। ওরা আমার মতো অনেক মানুষের সর্বনাশ করেছে। সবাই মুখ খোলার অপেক্ষায় আছে।

উল্লেখ্য, গত ২২শে ফেব্রুয়ারি অর্থপাচার, বিদেশি জাল মুদ্রা সংরক্ষণ ও মাদক ব্যবসার অভিযোগে র‌্যাব-১ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে পাপিয়া, তার স্বামী ও দুই সহযোগীকে। পরে তাদের নিয়ে ফার্মগেটের বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ৫৮ লাখ টাকা, বিদেশি মুদ্রা ও পিস্তল, গুলি ও মদ উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি এবং শেরেবাংলা নগর থানায় দুটি মামলা করে র‌্যাব। তিন মামলায় পাপিয়াসহ চারজন ১৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। মামলাটি এখন ডিবিতে রয়েছে। এছাড়া পাপিয়াসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে র‌্যাব।
তথ্য সূত্র :: দৈনিক ইনকিলাব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *