দিগন্তের আলো ডেস্ক :
অশ্লীল ভিডিওতে ঠাসা পাপিয়ার মোবাইল ফোন
পাপিয়াসহ চারজন ১৫ দিনের রিমান্ডে * ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার ব্যবসায়ী আমলা ও রাজনৈতিক নেতার তালিকা র্যাবের হাতে
অশ্লীল ভিডিওতে ঠাসা সদ্য বহিষ্কৃত যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীম নূর পাপিয়া ওরফে পিউর মোবাইল ফোন। এসব ভিডিওতে সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে উঠতি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ছাড়াও আমলা এবং কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার অশ্লীল ছবি রয়েছে।
এরই মধ্যে কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেছেন, রাজনীতির আড়ালে মাদক ও নারীদের নিয়ে ‘বাণিজ্য’ করতেন পাপিয়া। রাজধানীর তারকা হোটেলগুলোয় মাঝেমধ্যেই ‘ককটেল পার্টি’র আয়োজন করতেন।
এসব পার্টিতে উপস্থিত হতেন সমাজের উচ্চস্তরের লোকজন। মদের পাশাপাশি পার্টিতে উপস্থিত থাকত উঠতি বয়সী সুন্দরী তরুণীরা। মদের নেশায় টালমাটাল আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কৌশলে ধারণ করা হতো ওই তরুণীদের অশ্লীল ভিডিও। পরে ওইসব ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করতেন পাপিয়া।
বনিবনা না হলেই ফেসবুকে ছড়িয়েও দেয়া হতো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে র্যাবের ওই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই পাপিয়ার কাছ থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক মাথা ঘুরিয়ে দেয়া খবর। পাপিয়ার অপকর্মের সঙ্গীদের ধরতে এরই মধ্যে একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান চলছে।
তবে এসব অভিযান নিয়ে র্যাব এখনই মুখ খুলতে চাইছে না। এদিকে অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকা উদ্ধারের ৩ মামলায় পাপিয়া দম্পতির ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার শুনানি শেষে ঢাকার দুই হাকিম আদালত আসামিদের রিমান্ডে পাঠান। কোর্ট রিপোর্টার জানান, সোমবার দুপুরে আসামিদের সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়।
প্রথমে তাদের হাজাতখানায় রাখা হয়। বিকাল সাড়ে ৩টায় তাদের এজলাসে তোলা হয়। পৌনে ৪টায় রিমান্ড শুনানি শুরু হয়। প্রথমে বিমানবন্দর থানার জাল টাকা উদ্ধারে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীসহ অপর দুই সহযোগী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তাইবা নূরের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ-উর-রহমান আসামিদের রিমান্ডে পাঠান। পরে শেরেবাংলা নগর থানার অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীর ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসীম আসামিদের রিমান্ডে পাঠান।
অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় শুধু পাপিয়া দম্পতিকে আসামি করা হয়েছে। তিনটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষে তাপস কুমার পাল, আজাদ রহমান, হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ আসামিদের রিমান্ডের শুনানি করেন।
অপরদিকে আসামিপক্ষে আইনজীবী ইলতুৎমিশ সওদাগর, কলিম মৃধা, কামলা হোসেন তিনটি মামলায় রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আসামিদের জামিন নাকচ করে রিমান্ডে পাঠান।
এর আগে শনিবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগের সময় পাপিয়া ও তার স্বামীসহ ৪ জনকে আটক করে র্যাব-১। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র্যাব সদস্যরা ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে পাপিয়া-মফিজুরের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক বই, বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করেন।
এ সময় বিদেশি পিস্তল এবং দুটি ম্যাগাজিনে ২০ রাউন্ড গুলিও উদ্ধার করা হয়। পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা করার পর পাপিয়ার পাপের সহযোগীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে র্যাব।
র্যাবের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাল টাকা এবং নারীঘটিত কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পাপিয়ার অজানা সব কাহিনী বেরিয়ে আসছে। বিদেশে টাকা পাচারসহ ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এসব ঘটনায় তার সঙ্গে আর কারা জড়িত জিজ্ঞাসাবাদে সে তথ্যও মিলেছে। অভিযান অব্যাহত আছে।
র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সোমবার যুগান্তরকে বলেছেন, রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এফডিসি গেট সংলগ্ন এলাকায় পাপিয়ার যৌথ মালিকানাধীন শোরুম ‘কার এক্সচেঞ্জ’ এবং নরসিংদীতে ‘কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সলুশন’ নামে গাড়ি সার্ভিসিং সেন্টার রয়েছে।
তবে এসব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডই ছিল তার প্রধান কাজ। অধিকাংশ সময়ই তিনি নরসিংদী ও ঢাকার বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করতেন। চাঁদাবাজির জন্য নরসিংদীতে তার ক্যাডার বাহিনীও আছে।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব অপকর্ম করে অল্প সময়েই তিনি নরসিংদী ও ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক বনে গেছেন। পাপিয়ার স্বামী সুমন স্ত্রীর ব্যবসায় সহযোগিতার পাশাপাশি থাইল্যান্ডে বারের ব্যবসা করেন। তবে তাদের মূল ব্যবসা ছিল উঠতি শিল্পপতি-ব্যবসায়ীসহ সমাজের উঁচুস্তরের লোকদের ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়।
আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, নরসিংদী ও ঢাকার অনেক তরুণীকে চাকরির নামে তারকা হোটেলে ডেকে পার্টি গার্ল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া ফেসবুকে প্রকাশ্যে যৌন ব্যবসার গ্র“প ‘এসকর্ট’ থেকেও সুন্দরীদের সংগ্রহ করতেন পাপিয়া।
পরে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে শয্যাসঙ্গী করতে বাধ্য করতেন। এসব কুকর্মের বেশকিছু ভিডিও এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। কী আছে এসব ভিডিও ক্লিপে? এমন প্রশ্নে র্যাব কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, পাপিয়ার মোবাইল ফোন অশ্লীল ভিডিওতে ঠাসা। অশ্লীল ভিডিও তুলে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতেন পাপিয়া।
লজ্জায় কেউ মুখ খুলত না। এসব ভিডিওতে থাকা ৭ জন উঠতি বয়সী তরুণীর সঙ্গে র্যাবের কথা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, টিপসের বাইরে এসব তরুণীকে মাসে ৩০ হাজার টাকা করে দিতেন পাপিয়া।
এসব তরুণীকে আইনের আওতায় আনা হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, তাদের অপরাধের বিষয়টিও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এসব তরুণী যদি ব্ল্যাকমেইলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তবে তাদেরও আইনের মুখোমুখি হতে হবে।
এদিকে পাপিয়ার বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস জানার চেষ্টা করছে র্যাব। র্যাব জানতে পেরেছে, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী অনলাইন ক্যাসিনোর গডফাদার সেলিম প্রধানের গুলশানের বাসায় ক্যাসিনো খেলতেন। সেলিম প্রধান কারাগারে গেলেও অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।
এদের মধ্যে পাপিয়া ও সুমন চৌধুরী অন্যতম। র্যাব-১-এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল গণমাধ্যমকে বলেছেন, পাপিয়ার অপরাধ সম্পর্কে জানতে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। শুধু ক্যাসিনো নয় আর কোথা থেকে সম্পদ অর্জন করেছে, সেদিকেও আমরা নজর দেব।
সুমনের পিএস সাব্বির আহমেদ ও পাপিয়ার পিএস শেখ তায়্যিবার দেয়া তথ্যে র্যাব জানতে পেরেছে, ক্যাসিনোর টাকা দিয়েই ২০১৮ সালে ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে এবং ২০১৯ সালে দুটি ফ্ল্যাট কেনেন।
পাপিয়া-সুমন দম্পতিকে আটকের অভিযানে ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিমানবন্দরে যখন পাপিয়া, তার স্বামী সুমন চৌধুরী, সহকারী সাব্বির আহমেদ ও শেখ তায়্যিবাকে আটক করা হয় তখন তারা র্যাব সদস্যদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে তাদেরকে বিমানবন্দরের বহির্গমন পথে আটকানো হয়। এ সময় পাপিয়া বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যকে ফোন করার জন্য মোবাইল বের করেন। তবে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ, কেউ তার ফোন ধরেননি।
সূত্র যুগান্তর