(পর্ব ১)
সাহাদাত হোসেন দিপু ঃ-
লক্ষীপুরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অধিকাংশ এনজিও সংস্থা। এমনিতেই রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল, তার উপরে অভাব অনটন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষির অনগ্রসরতা এসব নানা কারণেই প্রতিনিয়িত কৃষক, হতদরিদ্র, ও নিম্ন আয়ের লোকেরা বন্দি হচ্ছে নামি দামি এনজিও ঋণের ফাঁদে। এমনিতেই বেকারত্বের সংখ্যা দ্বিগুন তার ওপর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও সমিতি থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি শোধের চাপে দিশেহারা হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের লোকেরা।
(আরও পড়ুন মান্দারীতে কিস্তির টাকা দিতে না পারায়, রাস্তা থেকে জোরপূর্বক এক বৃদ্ধা মহিলাকে আটকে রেখে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে একটি এনজিও সংস্থার বিরুদ্ধে)
ইতিমধ্যে এনজিওর ঋণের টাকা পরিশোধে অনেকে শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন। এনজিও কর্মী অথবা সমিতির লোকজন বাড়িতে গিয়ে কিস্তি শোধের চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতে হয়রানিও করছেন।
জানা যায়, সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে লক্ষীপুর সদর উপজেলার শহর ও গ্রামে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে প্রায় শ’খানেক নাম সর্বস্ব এনজিও। অনেক এনজিও’র কোন বৈধতা না থাকলেও বহাল তবিয়তে ঋণ আদান প্রদান করছে।
অভিযোগে উঠেছে, দায়িত্বশীলদের উদাসিনতার কারণে এসব এনজিও’র দৌরাত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। হাজার হাজার গরীব ও অসহায় মানুষ এনজিও ঋণে সর্বস্ব হারাচ্ছে। এক কিস্তি পরিশোধ করতে না করতেই সামনের কিস্তির টাকা পরিশোধের চিন্তা মাথায় চাপে। একটি সংস্থার ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই অন্য সংস্থার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে তারা। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, ভয়ে গ্রাহকদের কেউ কেউ বাড়ি ছেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আত্মহত্যার মত পথ বেছে নেয়ারও নজির রয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল হলেই ঋণের টাকার কিস্তির জন্য হাজির হয় এনজিও কর্মীরা। তাদের দেখলেই চমকে ওঠেন দরিদ্র মানুষ। বিভিন্ন এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে অভাবগ্রস্ত মানুষ এখন দিশেহারা। অনেক পরিবার একাধিক এনজিওর ঋণে জর্জরিত। একটির কিস্তি পরিশোধ করতে না করতেই অন্যটির টাকা জোগাড় করতে হয়।
এক ঋণ থেকে বাঁচতে অন্য ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে তারা। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গৃহবধূর স্বর্ণালঙ্কার, হালের পশু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করেও পার পাচ্ছে না অনেক পরিবার। শেষ সম্বল বাপ-দাদার বসতভিটাও বিক্রি করেছেন অনেকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রাম অঞ্চলের সাধারন জনগন এসব এনজিও’র জালে শিকার হয়ে ঋণের সর্বস্ব খুইয়ে এখন সর্বশান্ত দিশেহারা।
অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষি ঋণ বিতরণে ব্যাপক প্রচার থাকলেও কৃষকদের একটি বড় অংশ এই ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । এনজিওগুলো বিভিন্ন সামাজিক কাজের প্রোগ্রাম দেখালেও মূলত সেসব নিছক লোক দেখানো। প্রাথমিকভাবে এনজিও কর্মীরা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের আশ্বাস দিয়ে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু এদের ঋণের সুদের হার ব্যাংক ঋণের সুদের চেয়ে প্রায় ৪গুন বেশি। তাই দরিদ্র দূরীকরণের নামে গ্রামে-গঞ্জে শত শত সমিতি গড়ে উঠলেও ফল উল্টো। প্রথমদিকে এসব সমিতির কোন সদস্যই জানে না ঋণের সুদের হার কত? এনজিওগুলোর নিয়ম অনুযায়ী উৎপাদন বা আয় থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
(আরও পড়ুন মান্দারীতে কিস্তির টাকা দিতে না পারায়, রাস্তা থেকে জোরপূর্বক এক বৃদ্ধ মহিলাকে, এনে আটক রাখার অভিযোগ উঠেছে এক এনজিও সংস্থার বিরুদ্ধে)
এমনও দেখা গেছে, অনেকে বসতঘরের টিনের চালা, গরু-ছাগল বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেকে ভিটামাটি বিক্রি করে বড় কোন শহর কিংবা বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গৃহবধূর গহনা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী বিক্রি করেও পার পাচ্ছে না অনেক পরিবার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে ঋণ নেয়ার পর সঠিক সময়ে পরিশোধ করলেও জমির দলিল ফেরৎ দিতে টালবাহানা করে অনেক এনজিও। নিয়মানুযায়ী ঋণের টাকায় উৎপাদন আয় থেকে কিস্তি পরিশোধের কথা থাকলেও সেটা মানছেনা অনেক সংস্থা।
জানা গেছে, উপজেলার বেশির ভাগ মানুষ এনজিও নির্ভর। বিশেষ করে ছোট যানবাহন চালক, শ্রমিক, মৎসজীবি থেকে শুরু করে সকলেই একাধিক এনজিও ঋণের উপর নির্ভর। এজন্য বৈধ অবৈধ এনজিওর ছড়াছড়ি। আর এনজিও গুলোর কাজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের ইচ্ছেমত চলে কার্যক্রম। দিন রাত ছুটি কিছুই থাকে না। তারা মানেন না সরকারি নিয়ম-কানুন। আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে চলে এনজিও আর কর্মকর্তা কর্মচারীরা সবাই থাকেন ওই ভবনে। সকাল সাতটা থেকে টানা রাত্রি আটটা ও নয়টা পর্যন্ত চালিয়ে যায় অফিস।
এছাড়াও এনজিওগুলো ঋণ প্রদানের সময় ঋণ গ্রহীতার সঙ্গে স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ঋণ দিলেও সঙ্গে আবার ঋণ গ্রহীতার স্বাক্ষরিত ব্যাংকের চেক জমা করে রাখে। সময়মত ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিপত্র বাদ দিয় ওই চেক ব্যাংক থেকে ডিসওনার করে ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা করে।
লক্ষীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান হোসেন বলেন,। সরকারি আইন অনুযায়ী এনজিওগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করছে কি-না সে বিষয়ে খোঁজখবর নেব। নাম-সর্বস্ব কিংবা অনিয়মের অভিযোগ পেলে, অভিযুক্ত এনজিও সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এলাকার সচেতন মানুষ জেলা-উপজেলা ঋণের সর্বগ্রাসী এ চক্র থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
(আরও পড়ুন মান্দারীতে কিস্তির টাকা দিতে না পারায়, রাস্তা থেকে জোরপূর্বক এক বৃদ্ধ মহিলাকে, এনে আটক রাখার অভিযোগ উঠেছে এক এনজিও সংস্থার বিরুদ্ধে)