লক্ষ্মীপুরে স্ত্রী হত্যা মামলায় স্বামী কারাগারে!

রামগতি

দিগন্তের আলো ডেস্ক ঃ-
রামগতিতে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক জেলে তার স্ত্রী পারুল বেগমকে হত্যার অভিযোগে দুই বছর তিন মাস কারাগারে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হন। এরপর এলাকায় গিয়ে জানতে পারেন, তার স্ত্রী ঢাকায় এক বাসায় গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন।

হোসেন বিভিন্ন মাধ্যমে স্ত্রীর খোঁজে ঢাকায় যান। সেখানে তিনি জানতে পারেন, হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পাঁচ দিন পর তার স্ত্রী ওই বাসাতেই ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে হত্যা করেননি, এটা প্রমাণ করতে কয়েক দিন ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন হোসেন।

অবশেষে মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) দুপুরে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি (অঞ্চল রামগতি) আদালতে হোসেন বাদী হয়ে চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন (প্রক্রিয়াধীন)। এ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন হোসেনের শ্বশুর মো. বাহার মিস্ত্রি, শাশুড়ি হাজেরা বেগম, শ্যালক মো. বাবুল। স্ত্রী হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রামগতি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মজিবুর রহমান তফাদারকেও আসামি করা হয়।

বিষয়টি মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করে জানান মোহাম্মদ হোসেনের আইনজীবী সামছুদ্দিন হিমেল ভূঁইয়া।

তিনি জানান, মামলাটি আদালতের বিচারক নুসরাত জামানের আদালতে রয়েছে। বিচারক অভিযোগ আমলে নিয়ে হোসেনের বিরুদ্ধে করা হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মজিবুরকে শোকজ করেছেন। হোসেনের নাবালক দুই শিশুকন্যার কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় মিথ্যা জবানবন্দি নেওয়ার অভিযোগে ১০ দিনের মধ্যে মজিবুরকে লিখিতভাবে জবাব দিতে বলা হয়েছে। হত্যা মামলাটি সিআইডি কর্মকর্তা এসআই আশরাফকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের নতুন ডিএনএ টেস্ট করে আদালতে দাখিল করার জন্য বলা হয়েছে। এর আগে ডিএনএ টেস্টের একটি রিপোর্ট জমা দেওয়া হলেও তা পারুলের ছিল না। পারুলের বাবার সঙ্গে ডিএনএ টেস্ট মেলেনি।

মামলার এজাহার সূত্র ও আইনজীবী জানান, জামিনে বের হয়ে হোসেন তার স্ত্রী পারুলের আত্মহত্যার ঘটনায় ঢাকার লালবাগ থানায় যে অপমৃত্যু মামলা ও হাসপাতালের ময়নাতদন্ত হয়েছে, তার প্রতিবেদন সংগ্রহ করেন। তখন থানা থেকে তাকে জানানো হয়, পারুলের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তার ভাই মো. বাবুলের কাছে মরদেহটি হস্তান্তর করা হয়। সব তথ্য-প্রমাণ নিয়ে বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) হোসেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি রামগতি আদালতে হাজির হন। আদালতের বিচারক নুসরাত জামান কাগজপত্র পর্যালোচনা করে রোববার (১৩ মার্চ) হত্যা মামলায় জবানবন্দি দেওয়া হোসেনের দুই মেয়ে ঝুমুর আক্তার ও নূপুর আক্তারকে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া ঝুমুরকে উপস্থিত করা হয়। রোববার ঝুমুর জবানবন্দি দেয়। তবে নূপুর কোথায় আছে তা জানা যায়নি।

পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মজিবুর রহমান তফাদারের শেখানো কথাতেই বাবার বিরুদ্ধে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে বলে নুসরাত জামানের আদালতকে জানায় ঝুমুর। কাগজপত্র পর্যালোচনা ও ঝুমুরের জবানবন্দি শুনে মামলা করার জন্য হোসেনকে বিচারক নুসরাত জামান পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোসেন পেশায় একজন জেলে। তিনি রামগতির আলেকজান্ডার ইউনিয়নের সুজন গ্রামের বাসিন্দা। মৌসুমে বেশির ভাগ সময়ই তাকে নদীতে থাকতে হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তার মা সৈয়দা খাতুন ও স্ত্রী পারুল বেগমের সঙ্গে ঝগড়া হয়। এ নিয়ে রাগ করে পারুল তার বাবার বাড়িতে চলে যান। এর চার দিন পর বাড়িতে এসে স্ত্রীকে না পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ করেন তিনি। কিন্তু না পেয়ে স্ত্রীর খোঁজে তিনি থানায় একটি জিডি করেন।

২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর বাড়ির পাশে সুজন গ্রামে বাংলালিংক টাওয়ারের পরিত্যক্ত টয়লেটে একটি অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। হাতের তিনটি তাবিজ দেখে পারুলের মরদেহ বলে চিহ্নিত করেন তার মা হাজেরা। পরে পারুলের বাবা মো. বাহার বাদী হয়ে জামাই হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে লক্ষ্মীপুর আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠান।

আদালত হোসেনকে কারাগারে পাঠান ১৫ অক্টোবর। কিন্তু ১৯ অক্টোবর তার স্ত্রী পারুল ঢাকার লালবাগ থানাধীন নিউ পল্টন রোড এলাকার মো. ফাহাদ নামে একজনের বাসায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। সেখানে তিনি গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। এ ঘটনায় লালবাগ থানায় অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ফরাজানা শারমিন ময়নাতদন্ত করেন। সেখানে থেকে পারুলের ভাই মো. বাবুল মরদেহ এনে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন।

কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হোসেনকে ফাঁসাতে গ্রামের অজ্ঞাতনামা একটি মরদেহকে নিজের মেয়ে দাবি করে হত্যা মামলা করেন তার শ্বশুর বাহার। মামলায় হোসেনের দুই মেয়ে ঝুমুর ও নূপুরকে মারধর ও ভয় দেখিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা মজিবুর রহমান আদালতে মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিলেন।

মূলত বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর পারুলের মা-বাবা তাকে ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজের জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। ঢাকার লালবাগ এলাকার মো. ফাহাদ নামে একজনের বাসায় তিনি গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। কিন্তু হোসেন জামিনে বেরিয়ে এলেও ঘটনাটি তার কাছ থেকে লুকিয়েছে শ্বশুরপক্ষ।

হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২৭ মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে বের হয়ে জানতে পারি আমার স্ত্রী ঢাকার একটি বাসায় কাজ করতেন। সেখানে খোঁজ করে জানতে পারি আমি গ্রেপ্তারের পাঁচ দিন পর আমার স্ত্রী ঢাকার ওই বাসায় আত্মহত্যা করেন। পরে আমি সব তথ্য-প্রমাণ আদালতে জমা দিয়েছি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হোসেন আরও বলেন, গেল রোজার ঈদের দিন মা আমাকে দেখতে কারাগারের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। তখন বাড়ির কাছে সড়ক পার হতে গিয়ে গাড়িচাপায় তিনি মারা যান। আমার দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে পারুলের মা-বাবা ঢাকায় মানুষের বাসায় কাজে দিয়ে দেয়। আমি কারাগার থেকে বের হয়ে তাদের খুঁজে বের করি। আমার বড় মেয়ে নূপুরের এখনো কোনো সন্ধান পাইনি। কারাগারে বসে মাকে হারিয়েছি। আমার জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আমি সব দিকে এখন নিঃস্ব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পারুলের বাবা মো. বাহার মিস্ত্রি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পারুল তার স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসার দিন আমি বাড়িতে ছিলাম না। ১২ দিন পর আমি বাড়িতে এসে জানতে পারি। পরে একটি লাশ উদ্ধার হলে আমরা পারুলকে শনাক্ত করি। এ ঘটনায় মামলা করলে তার স্বামীকে পুলিশ জেলে পাঠায়।

কিন্তু পারুল ঢাকায় আত্মহত্যা করেছে কি না বা পারুলের ভাই বাবুল লালবাগ থানা থেকে মরদেহ গ্রহণ করেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, পারুল ঢাকায় ছিল কি না, কিংবা ঢাকায় আত্মহত্যার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার ছেলে বাবুল আমাকে কিছু জানায়নি।

তবে ছেলে বাবুলের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি ছেলের নম্বর পরে দেবেন বলে জানান। আজ মঙ্গলবার বিকেলে বাহারের নম্বরে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রামগতি থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মজিবুর রহমান তফাদারকে মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে বিষয়টি নিয়ে এখন কথা বলতে চান না বলে কল কেটে দেন।

রামগতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ থানায় নতুন যোগদান করেছি। ঘটনা সম্পর্কে কিছুই আমি জানি না। আদালতের ঘটনা আমার জানার কথাও নয়। এসআই মজিবুর রহমানকে আদালত শোকজ করেছে কি না, তা-ও বলতে পারছি না। কারণ, এ ব্যাপারে আদালত থেকে কোনো কাগজপত্র আসেনি।

প্রসঙ্গত, হোসেন আর পারুলের দ্বিতীয় সংসার ছিল। পারুলের প্রথম স্বামীর নাম আবুল কালাম। সে মেতাবেক ঢাকার লালবাগ থানায় অপমৃত্যুর মামলা ও ময়নাতদন্তের প্রত্যয়নপত্রে প্রথম স্বামীর নাম লেখা হয়েছে। পারুলের বাবা বাহার উপজেলার বড়খেরী ইউনিয়নের বড়খেরী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বর্তমানে পরিবার নিয়ে তিনি উপজেলার চরগাজী বয়ারচরের দিদার বাজার এলাকায় বসবাস করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *