দিগন্ত ডেস্ক :-
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান আহমেদ। স্কুল বন্ধ থাকায় সবজির দোকান নিয়ে বসেছে মিঠাপুকুর উপজেলায় ভেণ্ডাবাড়ী বাজারে। আদনানের বাবা রংপুরে একটি রেস্তরাঁয় কাজ করতেন। চাকরি হারিয়ে দিশাহারা। বাধ্য হয়ে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন এখন। সেইসঙ্গে আদনানের সবজির দোকান দিয়ে চলছে তাদের পাঁচজনের সংসার। আদনানের মতো কাজে প্রবেশ করেছেন একই উপজেলার শঠিবাড়ির ছেলে মো. জীবন। তার বাবা মিরপুর ১ নম্বর মার্কেটে গালামাল পরিবহনের কাজ করতেন।
মালিক লোকসানে থাকায় কাজ হারিয়েছেন তিনি। এরপর এলাকায় ফিরে দেন সাইকেল, ভ্যান মেরামতের দোকান। জীবন জানায়, তার বাবা কাজ হারিয়ে বাড়িতে এসে বিপদে পড়ে যান। জীবন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়ে কোনো এসাইন্টমেন্ট জমা দেয়নি। জীবন বলে, ‘আব্বায় একায় কাম করলে কামাই হয় না। যা হয় এদিয়ে সবার প্যাট ভরে না। আমি সবার বড়। আমি কামে আইলে ভালো আয় হয়। আব্বার কাজে সাহায্য হয়। আর স্কুলে ফিরবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে জীবন বলে, আর স্কুল যাইয়া কি হবে? কোনোরকম পাস দেয়া ছাত্র আমি। কাম না করলে ভাত জোটে না। আর লেখাপড়া করে কি হবে?’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ৫০২ দিন। গ্রামাঞ্চলে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা এই দীর্ঘ বন্ধে আরও পিছিয়ে গেছে। ছাত্ররা দারিদ্র্য মোকাবিলায় প্রবেশ করেছে আয়মুখী কাজে। আর মেয়েরা বাল্যবিবাহের ছোবলে জর্জরিত। এবারের কোরবানির ঈদে স্বামীসহ ঈদ করতে এসেছে পারুল। সে এবার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বিয়ে হয়েছে জানুয়ারি মাসে। স্বামী পোশাক শ্রমিক, থাকে গাজীপুরে। পারুলের বাবা মাইক্রোবাস চালক মো. বাবু বলেন, ‘বেটিক তো পড়াইচিলামই। বিয়াতো দেয়ই লাগতো। এহন বাড়িত বইসা আচিল। এই পোলার বাপ আমার পরিচিত। জমি-জায়গা আছে পোলায় কাম করে। পছন্দ করলো দিয়া দিলাম বিয়া।’ এত অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘এই বয়সে হের মায়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরচে। এগল্যা শহরের মানুষের জন্য বয়স কম সমস্যা। হেরা খায় ভেজাল, পুষ্টি পায় না। আমার ব্যাটা, ব্যাটি টাটকা খাইয়া বড় হইচে।’
পারুলের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে তার চার বান্ধবীও- জানান বাবু। হাসিনা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। লকডাউনের মাঝেই ঈদের পরদিন সীমিত পরিসরে হয়ে গেল তার বউভাত। যাতে লোকসমাগম হয়েছিল খুবই সীমিত। মাত্র চার ভ্যান মানুষ, ২০-২৫ জন।
করোনার আঘাতে জর্জরিত গোটা দেশ। এখন চলছে দ্বিতীয় ঢেউ। এ অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। আর সেইসঙ্গে গ্রামের বিত্তবান ঘরের শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে অনলাইন গেমিং, টিকটক ও গ্যাং কালচারে।
রংপুর জেলার মিঠাপুকুরের ডাবরা গ্রাম। প্রত্যন্ত এক গ্রাম। বিকাল হলেই দেখা যায়, ছেলেরা ক্রিকেট খেলতে ব্যস্ত। এরই মাঝে চলছে টিকটকের ভিডিও। রিয়াদ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। রিয়াদ বলে, সময় কাটানোটা জরুরি। আগে প্রাইভেট পড়তাম এখন সেটাও বন্ধ। এখন সকালে ১০-১১টার দিকে উঠি। এরপর এই মাঠে খেলি। এরপর দুপুরে খাওয়া শেষে বিকালে আবার খেলা। সন্ধ্যায় এই মাঠেই হয় আমাদের পাবজি চ্যাম্পিয়নশিপ। রাতেও চলে খেলা। রিয়াদ আরও বলছে, আগে আব্বু-আম্মু রাগারাগি করতো, এখন আর কিছু বলে না।
শঠিবাড়ি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরেন্দ্রনাথ সাহা। তিনি বলেন, আসলে কতজন শিক্ষার্থী আর ফিরবে না এটা স্কুল না খুললে বলা সম্ভব না। আমার স্কুলে দুই ধরনের শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। একেবারেই দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা হয়তো অনেকেই ফিরবে না। এই দীর্ঘ বন্ধে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের সঙ্গে বড় হওয়া শিক্ষার্থীদের হাতে যখন টাকা আসা শুরু হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীকে পুনরায় ফেরানোটা কষ্টকর, তবে দুঃসাধ্য নয়। কেমন আছে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা?
পিয়াস সরকার, রংপুর থেকে ফিরে
শেষের পাতা ৩১ জুলাই ২০২১, শনিবার
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান আহমেদ। স্কুল বন্ধ থাকায় সবজির দোকান নিয়ে বসেছে মিঠাপুকুর উপজেলায় ভেণ্ডাবাড়ী বাজারে। আদনানের বাবা রংপুরে একটি রেস্তরাঁয় কাজ করতেন। চাকরি হারিয়ে দিশাহারা। বাধ্য হয়ে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন এখন। সেইসঙ্গে আদনানের সবজির দোকান দিয়ে চলছে তাদের পাঁচজনের সংসার। আদনানের মতো কাজে প্রবেশ করেছেন একই উপজেলার শঠিবাড়ির ছেলে মো. জীবন। তার বাবা মিরপুর ১ নম্বর মার্কেটে গালামাল পরিবহনের কাজ করতেন।
মালিক লোকসানে থাকায় কাজ হারিয়েছেন তিনি। এরপর এলাকায় ফিরে দেন সাইকেল, ভ্যান মেরামতের দোকান। জীবন জানায়, তার বাবা কাজ হারিয়ে বাড়িতে এসে বিপদে পড়ে যান। জীবন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়ে কোনো এসাইন্টমেন্ট জমা দেয়নি। জীবন বলে, ‘আব্বায় একায় কাম করলে কামাই হয় না। যা হয় এদিয়ে সবার প্যাট ভরে না। আমি সবার বড়। আমি কামে আইলে ভালো আয় হয়। আব্বার কাজে সাহায্য হয়। আর স্কুলে ফিরবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে জীবন বলে, আর স্কুল যাইয়া কি হবে? কোনোরকম পাস দেয়া ছাত্র আমি। কাম না করলে ভাত জোটে না। আর লেখাপড়া করে কি হবে?’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ৫০২ দিন। গ্রামাঞ্চলে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা এই দীর্ঘ বন্ধে আরও পিছিয়ে গেছে। ছাত্ররা দারিদ্র্য মোকাবিলায় প্রবেশ করেছে আয়মুখী কাজে। আর মেয়েরা বাল্যবিবাহের ছোবলে জর্জরিত। এবারের কোরবানির ঈদে স্বামীসহ ঈদ করতে এসেছে পারুল। সে এবার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বিয়ে হয়েছে জানুয়ারি মাসে। স্বামী পোশাক শ্রমিক, থাকে গাজীপুরে। পারুলের বাবা মাইক্রোবাস চালক মো. বাবু বলেন, ‘বেটিক তো পড়াইচিলামই। বিয়াতো দেয়ই লাগতো। এহন বাড়িত বইসা আচিল। এই পোলার বাপ আমার পরিচিত। জমি-জায়গা আছে পোলায় কাম করে। পছন্দ করলো দিয়া দিলাম বিয়া।’ এত অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘এই বয়সে হের মায়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরচে। এগল্যা শহরের মানুষের জন্য বয়স কম সমস্যা। হেরা খায় ভেজাল, পুষ্টি পায় না। আমার ব্যাটা, ব্যাটি টাটকা খাইয়া বড় হইচে।’
পারুলের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে তার চার বান্ধবীও- জানান বাবু। হাসিনা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। লকডাউনের মাঝেই ঈদের পরদিন সীমিত পরিসরে হয়ে গেল তার বউভাত। যাতে লোকসমাগম হয়েছিল খুবই সীমিত। মাত্র চার ভ্যান মানুষ, ২০-২৫ জন।
করোনার আঘাতে জর্জরিত গোটা দেশ। এখন চলছে দ্বিতীয় ঢেউ। এ অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। আর সেইসঙ্গে গ্রামের বিত্তবান ঘরের শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে অনলাইন গেমিং, টিকটক ও গ্যাং কালচারে।
রংপুর জেলার মিঠাপুকুরের ডাবরা গ্রাম। প্রত্যন্ত এক গ্রাম। বিকাল হলেই দেখা যায়, ছেলেরা ক্রিকেট খেলতে ব্যস্ত। এরই মাঝে চলছে টিকটকের ভিডিও। রিয়াদ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। রিয়াদ বলে, সময় কাটানোটা জরুরি। আগে প্রাইভেট পড়তাম এখন সেটাও বন্ধ। এখন সকালে ১০-১১টার দিকে উঠি। এরপর এই মাঠে খেলি। এরপর দুপুরে খাওয়া শেষে বিকালে আবার খেলা। সন্ধ্যায় এই মাঠেই হয় আমাদের পাবজি চ্যাম্পিয়নশিপ। রাতেও চলে খেলা। রিয়াদ আরও বলছে, আগে আব্বু-আম্মু রাগারাগি করতো, এখন আর কিছু বলে না।
শঠিবাড়ি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরেন্দ্রনাথ সাহা। তিনি বলেন, আসলে কতজন শিক্ষার্থী আর ফিরবে না এটা স্কুল না খুললে বলা সম্ভব না। আমার স্কুলে দুই ধরনের শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। একেবারেই দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা হয়তো অনেকেই ফিরবে না। এই দীর্ঘ বন্ধে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের সঙ্গে বড় হওয়া শিক্ষার্থীদের হাতে যখন টাকা আসা শুরু হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীকে পুনরায় ফেরানোটা কষ্টকর, তবে দুঃসাধ্য নয়।