করোনা-লকডাউনে বিপাকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসার উপক্রম

বাংলাদেশ

দিগন্তের আলো ডেস্ক :-
রাজধানীর ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে প্যান্ট-শার্টের ব্যবসা করতেন আনিসুর রহমান। সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস এই স্বল্প আয়ের ব্যবসাটি। তবে লকডাউনে তা থেমে গেছে। বিকল্প কিছু খুঁজেও পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় কাছে থাকা অল্পকিছু জমানো টাকা আর ধারদেনা করে কোনোমতে চলছে তার সংসার। খেয়ে ফেলছেন ব্যবসার মূলধনও। এমন পরিস্থিতি আর কিছুদিন থাকলে তার পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না বলে জানান তিনি। শুধু আনিসুর নন, লকডাউনে এমন লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মহাসংকটের মধ্যে পড়েছেন।
ব্যবসা বন্ধ করে বেশির ভাগই গ্রামে ফিরে গেছেন। ব্যতিক্রম দুই একজনের বিকল্প ব্যবস্থা হলেও অধিকাংশরাই ব্যবসা হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে।

সরজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর ফার্মগেট, গ্রিনরোড, পান্থপথ, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর এলাকায় যেসব জায়গায় ফুটপাথে বসে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিকিকিনি করতেন, সেসব এলাকা যেন এখন নিস্তব্ধ। এসব জায়গায় ব্যবসা করে সংসার চালাতেন লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তবে লকডাউনে এখন সব বন্ধ। অন্যদিকে দোকান কেন্দ্রিক লাখ লাখ ব্যবসায়ীও একই হাল। দোকানপাট বন্ধ থাকায় একদিকে লোকসানে মালিকরা, অন্যদিকে কর্মচারীরা কাজ হারিয়ে বেকার। এমনিতেই মহামারির কারণে গত বছর থেকেই ব্যবসায় মন্দাবস্থা। দ্বিতীয় দফায় করোনার ধাক্কায় নতুন করে মহাসংকটে পড়েছে এই ব্যবসা খাত।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৭১৬। এসব ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর বৈশাখ, রমজান ও ঈদ কেন্দ্রিক প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে থাকেন। কিন্তু এবার লকডাউনে এসব ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন আহমেদ। মানবজমিনকে তিনি বলেন, ফুটপাথে ব্যবসা করা অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেমন ব্যবসা বন্ধ করে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, তেমনি দোকান কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন মহাসংকটে।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত ৫ই এপ্রিল থেকে চলাচলে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। পরে ১৪ই এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় দফা এবং সবশেষে ২১শে এপ্রিল থেকে তৃতীয় দফায় লকডাউন আরোপ করা হয়। এ অবস্থায় মার্কেট, দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ থাকায় পয়লা বৈশাখ, রমজান, ও ঈদ কেন্দ্রিক বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

মিরপুর বিআরটিএ্থর অপজিটের ফুটপাথে চামড়ার ব্যাগসহ মেয়েদের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতেন এখলাস। কিন্তু লকডাউনে এখন বন্ধ। তাই পরিবার চালাতে বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন কাঁচা তরকারির ব্যবসা। ভ্যানে করে বিভিন্ন গলির ভেতর ঘুরে তিনি কাঁচা তরকারি বিক্রি করেন। কিন্তু ভাড়ায় ভ্যান নিয়ে ব্যবসায় তেমন আয় হচ্ছে না। বিক্রিও কম। ফলে সংসার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিবার নিয়ে এভাবে বেঁচে থাকা মুশকিল। খরচ বাদ দিয়ে সারাদিনে মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা আয় হচ্ছে। আগে দিনে প্রায় ১-২ হাজার টাকা কামাই হতো। লকডাউন তুলে না নিলে আমাদের পথে বসতে হবে।

পান্থপথে সানগ্লাসের দোকান ছিল ইব্রাহীমের। লকডাউনে এখন দোকানটি বন্ধ। আপাতত সঞ্চয় করা টাকা দিয়েই চলছে তার সংসার। তবে লকডাউন আরো দীর্ঘ হলে ব্যবসার মূলধন হারানোর ভয় করছেন তিনি। তিনি বলেন, কাছে যা আছে তাই দিয়ে সংসার চলছে। দোকানে যা প্রোডাক্ট আছে সেগুলো বিক্রি করতে পারলে হয়তো আরো কিছুদিন চলতো। তখন নতুন করে দোকানে প্রোডাক্টও তুলতে পারতাম। এখন যে অবস্থা যাচ্ছে তাতে খুবই শঙ্কার মধ্যে আছি।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, দোকানপাট বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবছর বৈশাখ, রমজান ও ঈদ কেন্দ্রিক বড় পরিসরে ব্যবসা হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করে থাকেন। শুধু পয়লা বৈশাখে ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এ ছাড়া রমজান ও ঈদে আরো ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। সবমিলিয়ে ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। কিন্তু লকডাউনের কারণে সব ব্যবসা বন্ধ। লকডাউনের আগেই তারা বিনিয়োগ করেছিল। এখন ব্যবসা বন্ধ থাকায় বিনিয়োগের টাকা আর ফেরত আসবে না। ফলে বিনিয়োগের পুরো টাকাই তাদের লোকসানে চলে যাবে। দিনে অন্তত ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসায়ীরা আরো ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই পরিস্থিতিতে জীবন ও জীবিকা দুটিই প্রয়োজন। তাই স্বাস্থ্য বিধির বিষয়টি নিশ্চিত করে সব দোকানপাট খুলে দেয়া এবং অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ফুটপাথে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়ার দাবি জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *