দিগন্তের আলো ডেস্ক ঃ-
প্রথানিবিড় আইন ও বিচারব্যবস্থায় কিছু রীতি সাবেকি মনে হলেও তাত্পর্যপূর্ণ। যেমন—হাইকোর্টে স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া ১৮ বিচারপতিকে গত ৩১ মে দিনে ভার্চুয়াল মাধ্যমে এবং রাতে সশরীরে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, একই শপথ পাঠ দুবার কেন? উত্তর এসেছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে জানানো হয়, দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে অনেক বিচারপতিই প্রধান বিচারপতির পাঠ করা শপথবাক্য শুনতে পাননি। সে কারণে সেই সাবেকি রীতিতে শরীরী উপস্থিতিতে রাতে শপথের পুনঃপাঠ অনুষ্ঠিত হয়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে প্র্রায় প্রস্তুতিহীনভাবে অ্যাকচুয়াল থেকে ভার্চুয়াল স্তরে উত্তীর্ণ হয়। রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিচার বিভাগ প্রায় দেড় মাসের নীরবতা কাটিয়ে উঠে হালদা নদীর ডলফিন বাঁচানোর রিটের মধ্য দিয়ে। সে দিন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে আদালতে আইনি সেবাদান চলছে, আগামী আগস্টের ৮ তারিখ পর্যন্ত চলবে।
মানুষ তাৎক্ষণিকতা খুব পছন্দ করে। সে লাইন ভেঙে ঈদের ট্রেনের টিকিট প্রাপ্তি হোক আর মামলা জমা দিয়ে পরের দিনেই লিস্টে এনে শুনানি সম্পন্ন করাই হোক। ই-জুডিশিয়ারি, ভার্চুয়াল আদালত এই নতুন দিনের শব্দগুলো যে দ্রুততার দ্যোতনা সৃষ্টি করেন আদতে আমরা আইনজীবীরা, যেমন—পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীরাও জানেন বাস্তবতা তেমন না। যে কারণে শরীরী উপস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালত খুলে দেওয়ার বিষয়ে আইনজীবীদের বিরাট অংশ আন্দোলন ও প্রতিবাদ ইত্যাদি কার্যক্রমে মুখর।
৮ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার বিল-২০২০’ পাস হয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম চালানোর সুযোগ রেখে গত ৭ মে মন্ত্রিসভা এসংক্রান্ত অধ্যাদেশের অনুমোদন দেওয়ার পর তার ভিত্তিতে ভার্চুয়াল আদালতের কাজ চলছিল।
অধ্যাদেশটি আইন হিসেবে পাস করতে সংসদে বিল তোলা হয় গত ২৩ জুন। বিধান অনুযায়ী বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি বিলটি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ২৯ জুন বিল পরীক্ষা করে সংসদে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রয়োজনীয় সংসদীয় নিরীক্ষা শেষে আইন আকারে পাস হয়। যেকোনো পরিবর্তনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সব সময় যে ইতিবাচক হয় না এর ফলিত রূপায়ণ আমাদের দেশে আগেও দেখা গেছে। কারণ যেভাবে চলছিল ভালোই তো ছিল, এমন আবহমানতায় আমরা ভালোভাবেই অভ্যস্ত। একজন ব্যবহারজীবী বিচার ও আইনি সেবাদান ব্যবস্থার অংশীজন হিসেবে এর ব্যবস্থাপনার ব্যবচ্ছেদ করার স্বত্ব সংরক্ষণ করে থাকেন।
নীতি নিশ্চলতা আমাদের কাঠামোগত আইনি সেবাদান প্রক্রিয়ায় একটি মৌলিক প্রবণতা। আদতে বৈশিষ্ট্যের রূপ পেয়েছে বলা যায়। সাধারণ সময়ের মতো স্বাভাবিক আদালত কার্যক্রম এখন চলছে না। আবহমান সময় ধরে চলা একটা রীতি হঠাত্ বদলে গেলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই ধাতস্থ হতে কমবেশি সময় লাগে। যার সম্মুখীন হচ্ছেন উচ্চ আদালত ও জেলা পর্যায়ের আইনজীবীরা। একে তো এখন আদালত কার্যক্রম সীমিত পরিসরে, তার ওপর কোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সেই চিরায়ত তদবিরনির্ভর নথির গতি প্রাপ্যতা দেওয়া পুরো প্রক্রিয়াকে অনেকের কাছে অসহনীয় করে তুলেছে। একজন বিজ্ঞ সহকর্মী তিন দফায় তাঁর পিটিশন পাঠালেও আদালত সংশ্লিষ্টদের অব্যাহত অস্বীকারের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে শারীরিকভাবে আদালতে উপস্থিত হয়ে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে তিনি পাঠিয়েছেন এবং তাঁর উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেন যে তাঁরা ই-মেইলে পিটিশন পেয়েছেন। শারীরিক অনুপস্থিতি কি রক্ষা করা গেল? সার্টিফাইড কপি গ্রহণ করা থেকে শুরু করে প্রিন্ট কপি থেকে স্ক্যান করার প্রক্রিয়ায় একজন আইনজীবীকে একাধিকবার আদালতে আসতেই হয়। ইদানীং আরেকটি জটিলতা একেক কোর্টের মামলা গ্রহেণের একেক প্রক্রিয়া, এ ক্ষেত্রে এককভাবে নির্ধারিত পিটিশন গ্রহণের পদ্ধতি আইনজীবীদের ভোগান্তি কমাবে। আপত্কালীন সময়ের বিবেচনায় কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম চালনা থেকে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা যাবে, যদি উল্লিখিত পদ্ধতিগত অসামঞ্জস্যগুলো দূর করা যায়। যদিও ভার্চুয়াল কোর্ট অ্যাকচুয়াল কোর্টের বিকল্প নয় ।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ভার্চুয়াল আদালত নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এর যে বিচারিক ক্ষমতা, তাতে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের হতাশাই শুধু বেড়েছে। এখন নামেই শুধু আদালত চলছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে সচিবালয়, অফিস, গণপরিবহন, হাট-বাজার সবই চলছে। কেবল আদালতই চলছে না। কারণ প্রশাসন চায় না বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী হোক। করোনা পরিস্থিতিতে প্রশাসনই বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এগুলো অশুভ লক্ষণ।’ (সূত্র : সমকাল ২৫ জুলাই)। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে মামলাসংক্রান্ত কার্যক্রম চালানোর মাধ্যমে এটা অন্তত পরিষ্কার হয়েছে করোনোত্তর সময়েও মামলার চাপে জর্জরিত বিচারকাঠামোর বোঝা হালকা করতে স্বাভাবিক আদালত কার্যক্রমের পাশাপাশি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতেও কিছু মামলা চলতে পারে, এতে সব পক্ষেরই সময় ও সম্পদের সাশ্রয় নিশ্চিত হবে। আর ভবিষ্যতে বার কাউন্সিলে আইনজীবীদের তালিকাভুক্তির সময় তথ্য-প্রযুক্তির সাধারণজ্ঞানের শিক্ষাসংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আর উচ্চ আদালতে প্র্যাকটিস পারমিশন পাওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ আইটি লিটারেসি নিশ্চিত করে তালিকাভুক্তির বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
অনেকটা উইনার টেকস অলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূণর্, হারজিতের যে ক্রীড়াসুলভ অন্তর্গত অনিশ্চয়তা সেটি আইন পেশার অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য। জুনিয়র আইনজীবীরা মামলায় ইতিবাচক ফলাফল নিশ্চিত করতে না পারলে শুধু খেলায় পার্টিসিপেশন ফির মতো এ ক্ষেত্রে মামলার ফাইলিং ফির কিছু পরিমাণ পান, সিনিয়র আইনজীবীদের এ সমস্যা নেই। স্বাভাবিক সময়ের প্রেক্ষপটে এসব অনিশ্চয়তা জেনেও প্রতিবছর অনেক আইনজীবী তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু গত কয়েক মাসের তুলনাহীন পেশাগত অচলাবস্থা অনেক তরুণ আইনজীবীর পেশা ও জীবিকানির্ভর সামাজিক জীবনকে রীতিমতো অনিশ্চিত করে তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে ভার্চুয়াল আর অ্যাকচুয়াল কোর্টের বিরোধ নয়, বরং সহাবস্থানের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের আইন সেবা প্রাপ্তি আর আইনজীবীদের পেশাগত অনিশ্চয়তায় ভারসম্য আনতে পারে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট