দিগন্ত ডেস্ক
মানুষের আয়ু কমাতে অনেকটাই ভূমিকা রাখছে বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পিএম ২.৫)। বাতাসের বিষ যে মানুষের আয়ু হ্রাস করছে এমনটা পরিবেশকর্মী থেকে চিকিৎসকদের একাংশ বারবারই বলছেন। তবে সেই দূষণ কীভাবে মানুষের আয়ু কমাচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে নতুন একটি পরীক্ষায়। সমীক্ষাটি চালিয়েছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (এপিক ইন্ডিয়া) ।
জানা গেছে, বাতাসের দূষণ ও মানুষের আয়ুর উপর তার প্রভাব নিয়ে একটি নতুন সূচক চালু করেছে এপিক ইন্ডিয়া। একে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স বা একিউএলআই।
সোমবার কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় ওই সংস্থার সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর আশীর্বাদ স্নেহদীপ রাহা এ বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
ওই তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা সহনসীমার মধ্যে থাকলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের গড় আয়ু আরও ৩ বছর ৮ মাস বাড়তে পারত। অর্থাৎ ২০১৬-তে দূষণমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় যতটা বেশি ছিল, তাতে মানুষের গড় আয়ু ৩.৮ বছর কমে যাচ্ছে।
শুধু রাজ্যের গড় নয়, কলকাতাসহ বিভিন্ন জেলার ছবিও উঠে এসেছে এপিক ইন্ডিয়ার তথ্যে। কলকাতার নাগরিকেরা গড়ে প্রায় সাড়ে তিন বছর আয়ু হারাচ্ছেন। তবে উদ্বেগের তথ্য যেটা, শুধু কলকাতার মতো মেট্রো শহরই বায়ুদূষণে জর্জরিত, এমনটা নয়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ছবি আরও খারাপ। উত্তরবঙ্গের দুই দিনাজপুর জেলা বা দক্ষিণবঙ্গের বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়ার মতো জেলার বাসিন্দারা দূষণের জেরে গড়ে চার বছরের বেশি আয়ু হারাচ্ছেন।
এক্ষেত্রে দূষণের সহনসীমা হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) পরিমাণকে ধরা হচ্ছে। বছরের নিরিখে বাতাসে পিএম ২.৫ প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম থাকলে তাকে সহনশীল মাত্রা বলে চিহ্নিত করে ডব্লিউএইচও । যদিও কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মাপকাঠিতে এই সহনমাত্রা ৪০ মাইক্রোগ্রাম।
আশীর্বাদ বলেছেন, কানাডার ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমসফেরিক কম্পোজিশন অ্যানালিসিস গ্রুপের সূত্রে পাওয়া স্যাটেলাইট ডেটা ও গ্রাউন্ড লেভেল ডেটাকে আমাদের তৈরি মডেলে বিশ্লেষণ করে একিউএলআই বের করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দূষণ কীভাবে মানব শরীরে প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে একাধিক মডেল আছে। বিভিন্ন মডেলে যে তথ্য উঠে আসছে, তাতে সামান্য হেরফের হলেও সামগ্রিক একটা ছবি পাওয়া যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা পিএম ২.৫ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মানব শরীরে ঢুকে রক্তে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে যেমন শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে, তেমনই হতে পারে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগও। এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের
হেমাটোলজি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রান্তর চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা, ‘১০-১৫ বছর আগেও বাতাসে পিএম ২.৫ সেভাবে পাওয়াই যেত না। এখন প্রায় সারা বছরই পিএম ২.৫-এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকছে। শুধু তো ওই ধূলিকণা নয়, তার সঙ্গে ক্ষতিকারক রাসায়নিকও মানব শরীরে ঢুকছে।
পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, বাতাসের দূষণ মানব শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, এটা ঠিকই। কিন্তু যে মডেলের ভিত্তিতে বাতাসের দূষণের জন্য মানুষের আয়ুতে এতটা তারতম্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, মানুষের আয়ু শুধু বাতাসের দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এর পিছনে জল দূষণ, খাবারের অভাব, উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবার অভাব অনেক কিছুই রয়েছে।
গ্রামীণ এলাকার পরিস্থিতি বেশি খারাপ কেন? আশীর্বাদের ব্যাখ্যা, জেলাগুলিতে ফসলের গোড়া পোড়ানো, পুরোনো ডিজেল চালিত গাড়ির বেশি ব্যবহার এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে তুলনায় নজরদারি কম থাকা বড় কারণ।
ফুসফুস রোগ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষণের ছোবলের নিরিখে শহর-গ্রামের মধ্যে এখন বিশেষ ফারাক নেই। শহরে যেখানে গাড়ির ধোঁয়া সব চেয়ে বড় খলনায়ক, সেখানে পাড়াগাঁয়ে দূষণের প্রধান কারণ কাঠ ও কয়লার মতো জ্বালানির বিষ।