সংবাদে ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা যাদের নেই অথবা একাডেমিক শিক্ষা না থাকলে সাংবাদিকতার চর্চা কতটা অশ্লীল হতে পারে, ইদানিং কতিপয় ব্যক্তির লেখালেখি দেখলেই তা বোঝা যায়। সংবাদ কখনও অবৈধ দাবি আদায়ের ঠেকবাজি হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে না। সরকারের অনুমোদনহীন একটি অনলাইনের বার্ষিকীতে বিজ্ঞাপন না দেওয়ায় অথবা অনৈতিক অর্থ দাবি গ্রাহ্য না করায় ওই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ কাল্পনিক সংবাদ প্রকাশ কোন সাংবাদিকতার নীতিমালায় পড়ে জানার অধিকার সবার আছে।
অষ্টমশ্রেণি পড়ুয়া ছাত্রী এবং দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছাত্র একসাথে দেখা স্বাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই সেদিন চন্দ্রবিন্দু চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে উঠেছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানতে পারি। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তারা একে অপরের সাথে দেখা করতে এসেছিল। ধরেই নিলাম তারা প্রেমিক প্রেমিকা। তাই হয়তো হাত ধরাধরি করে রেষ্টুরেন্টের দোতলায় ওঠছিল তারা। এসময় তাদেরকে হেনস্তা করে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর ছেলে মেয়ে উভয় পরিবারের অভিভাবকরা সন্ধ্যায় তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যায়। এখানে হাত ধরাধরি যৌনতার কোন সংজ্ঞায় পড়ে, আমার জানা নেই।
এ ঘটনায় অনেকগুলো আইনগত প্রশ্ন জেগেছে আমার মধ্যে।
প্রথমত; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কোনো ধরণের ডকুমেন্টারী তথ্য প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অবৈধ মেলামেশা বা অনৈতিক, অসামাজিক কার্যকলাপ চলে এরকম স্ট্যাটাস দেওয়ার আইনগত বৈধতা কারো আছে কীনা? একই সাথে ওই ফেসবুক স্ট্যাটাসে কুরুচিপূর্ণ বা অশালীন ভাষা ব্যবহার কোনো মানুষ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেমন ধারণা জন্মাতে পারে? এরকম ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনে কী আছে? ভাষার বহুবিধ প্রয়োগ সম্পর্কে মাধ্যমিক গন্ডি থেকেই আমরা ধারণা পেয়েছি। সংবাদকর্মী হিসেবে তো ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। কারণ, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক ছাড়াও এখন জুনিয়র লেভেল বা আমাদের সন্তানরা ফেসবুক ব্যবহার করছে। সেখানে শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে আরো মার্জিত ভাষার ব্যবহার একান্ত বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু যে ভাষা ব্যবহার হয়েছে, তা নিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সাধারণ অনেক মানুষ নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয়ত; ক্ষুদ্র একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালিয়ে কোনো মতে সংসার চলছে চন্দ্রবিন্দু চাইনিজের মালিক তুহিনের। আমাদের এলাকারই ছেলে। দীর্ঘদিন করোনায় লকডাউনের কারণে এসব ছোট ব্যবসায়ীরা এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে ওই চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে কোনো ধরণের অবৈধ মেলামেশার ভিডিও চিত্র বা ছবি ডকুমেন্ট ছাড়া কীভাবে মনগড়া সংবাদ প্রকাশিত হয়। এখন ক্ষতিগ্রস্ত ওই ব্যবসায়ী আদালতের ধারস্ত হলে আপনি কী অভিযোগটি প্রমাণ করতে পারবেন?
তৃতীয়ত; অষ্টমশ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী এবং দশমশ্রেণিতে পড়ুয়া ওই ছাত্রকে পুলিশ ডেকে এনে যে তুলে দিলেন। এই দুটি ছেলে মেয়ে অপমানিতবোধ করে যে কোনো দুর্ঘটনাও ঘটাতে পারত। আর তা যদি হতো, তাহলে তার দায় নিত কে? পাশাপাশি ওই মেয়ে ও ছেলের পরিবার দুটি সামাজিকভাবে যে হেয়পতিপন্ন হয়েছে এবং সন্মানহানি হয়েছে এর দায়-দায়িত্ব কার? এই প্রশ্নটি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। আমরা সবাই এই অপসাংবাদিকতার দায় এড়াতে পারি না।
আমরা জানি, গোয়েবলসীয় কায়দায় যে কোনো মিথ্যাকে বার বার বলা হলে সেটি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। গোয়েবলসের সূত্রই ছিল- “একটা মিথ্যাকে দশবার বলো, একশ’বার বলো, সেটা সত্যির মতোই শোনাবে।”
‘তিলকে তাল বানানো’ বাগধারাটির কথা আমরা প্রায়ই শুনি, মাঝেমধ্যে আমাদের চোখেও এর নজির ধরা পড়ে। কিন্তু গণমাধ্যমে তিল থেকে তালের উদ্ভবটা কার হাতে হয়েছিল, সেটা অনেকেই জানেন না। মানুষটাকে ভদ্রলোক বলা যাবে না কোনমতেই; নাম তার জোসেফ গোয়েবলস, ছিলেন হিটলারের তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী। যা কম্মিনকালেও ঘটার সম্ভাবনা নেই, এমন ঘটনা ঘটেছে রব তুলতে যার জুড়ি ছিলনা। শুধু ভাষণ-বক্তৃতায় নয়, খোদ রেডিও এবং খবরের কাগজে গুজবের বেসাতি ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেয়া আর স্বজাতির মনে সরকারের আনুগত্য সৃষ্টিটাই যার উদ্দেশ্য ছিল, সে মানুষটাই জোসেফ গোয়েবলস।
খুব বেশিদিন আয়ু পাননি গোয়েবলস, বেঁচেছিলেন মাত্র সাড়ে সাতচল্লিশ বছর; এরমধ্যেই অর্ধেক দুনিয়ার ঘৃণা অর্জন করে নিয়েছিলেন নিজের কীর্তিকলাপে। নাৎসী পার্টিতে যোগ দেয়ার পরে ১৯২৫ সালে হিটলারের সাথে প্রথম দেখা হয় তার, রতনে যেমন রতন চিনে, তেমনি নিকৃষ্ট ব্যক্তিরাও একে অপরকে চিনে নেন খুব সহজেই। হিটলার বুঝে গিয়েছিলেন, তার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গোয়েবলসকে খুব দরকার। পরের বছরই পদোন্নতি পেয়ে গোয়েবলস হয়ে গেলেন নাৎসী পার্টির বার্লিন শাখার প্রধান।
নাৎসী পার্টির সেই গোয়েবলসসের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন এখানকার কিছু হলুদ সাংবাদিক। আমি তাদেরকে ‘হলুদ সাংবাদিক’ হিসেবেই ট্রিট করতে চাই।
বাংলাদেশে ২০১৩/১৪ সালে গোয়েবলসের এই নীতি অনুসরণ করেছিল একটি জাতীয় পত্রিকা। যারা মক্কায় কাবা শরীফের গীলাব পরিবর্তনের ছবি ছাপিয়ে সেখানে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ক্যাপশনে লিখেছিল। পরে সেই পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় সরকার। আমাদের এখানে একজন প্রতিদিন তার ফেসবুক ওয়ালে সত্যের বাণী শোনান। তাহলে, কেউ কী তাকে মিথ্যাবাদির অপবাদ দিয়েছেন। না হলে, দিনে চল্লিশবার নিজে সত্যবাদি ঢোল পিটানোর কারণ কী আছে?
গত ২৭ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরে এসেছিলেন, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পালের সভাপতিত্বে আয়োজিত জেলার সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেন তিনি। সেখানে প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান বলেছেন, খুব শীঘ্রই ডাটাবেজ তৈরীর মাধ্যমে অপসাংবাদিকতা রোধ করা হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আগ্রহভরে অপেক্ষায় থাকলাম, যেন সেই ডাটাবেজ তৈরীর কাজটা দ্রুত সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয়।
প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যানের সাথে ওই মতবিনিময় সভায় প্রশিক্ষণ ধারণাপত্র নামে সাংবাদিকদের মধ্যে একটি বই বিতরণ করা হয়। ওই বইতে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ ‘সাংবাদিকতার নীতিমালা’ ‘আইন’, সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা, ‘সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতা’ ইত্যাদি সম্পর্কে বিষদ ধারণা দেওয়া আছে। বইটি অনেক আগ্রহ নিয়ে প্রত্যেকটি পাতা পড়েছিলাম। বইটিতে পেশাগত বিষয়ে জানার আছে অনেককিছু।
ওই বইয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালা অধ্যায়ের ১নম্বরে লেখা আছে : সংবাদক্ষেত্রের পরিবেশনা শালীনতার গ-ির মধ্যে থাকবে। অশোভন ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রত্যয়, শব্দ, তথ্য, বাক্য ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
৮নম্বরে লেখা আছে : ‘হলদে সাংবাদিকতা’ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রধান অন্তরায়। প্রত্যয়টি সাংবাদিকতা সংক্রান্ত আলোচনায় নিন্দনীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। সংবাদপত্রের রিপোর্টিংয়ে অকারণ চমক সৃষ্টি, প্রয়োজন অতিরিক্ত আকর্ষণ, রোমাঞ্চকর কিংবা উত্তেজক তথ্য উপাদান দিয়ে গণমাধ্যমে তা প্রকাশ ও প্রচার করার প্রবণতাকে এবং কখনো কখনো বানোয়াট ও ভিত্তিহীন খবর প্রকাশ করাকে সাংবাদিকতার পরিভাষায় ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ (ণবষষড়ি লড়ঁৎহধষরংস) বলে।
একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে আমি বা আমরা যখন দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে কাজ করছি, তখন আমাদের গৌরবময় কাজের মধ্যে কতিপয় লোক ছাঁই উড়িয়ে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র। এতে সাংবাদিকদের অবস্থান জ্বলজ্বল করার বিপরীতে ছাঁইয়ের প্রলেপে দূষর হয়ে যাচ্ছে। এটি কোনো ভাবেই আমরা হতে দিতে পারিনা।
একটা কথা আছে, অভাবে স্বভাব নষ্ট। কারণ; পেটে খিদে থাকলে হাজারটি ভালো কথা আর ভালোবাসার কোনো মূল থাকেনা। তবুও, বলতে হয় আমরা জাতির বিবেক। মানুষ আমাদের কাছ থেকে সবসময় ভালোকিছু আশা করেন। তাই; ক্ষুদ্র স্বার্থে সাংবাদিক হিসেবে আমি বা আমরা আমাদের নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারি না। অবশ্য; সমাজে এমন অনেক লোক আছেন, যাদের কাছে আমাদের এসব কথা অনেকটাই মূলহীন। কারণ, দলকানা এবং জ্ঞানপাপী এসব লোকের কাছে ভালো কথার কোনো মূল্য নেই।
মো. আলী হোসেন, সাংবাদিক ও লেখক