দিগন্তের আলো ডেস্ক ঃ-
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সর্বত্রই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আগাম বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের কাছেও বিভিন্ন মাধ্যমে এ আশঙ্কার কথা পৌঁছেছে। প্রস্তুতি হিসেবে বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে বিনা টিসিতে দেশের যেকোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বছরের যেকোনো সময়ে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে সূত্রগুলো বলছে শুধু প্রাথমিক পর্যায়েই নয়, কলেজে ভর্তি কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার এ চিত্র দিনকে দিন স্পষ্ট হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্প্রতি কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রথম দফায় অনলাইনে আবেদনই করেনি প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী। তবে ধারণা করা হচ্ছে ভর্তির দ্বিতীয় ধাপে এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ভর্তির আবেদন করবেন। এ বছর বিলম্বে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ এবং কলেজে ভর্তির সার্কুলার জারি করা হলেও এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তির আবেদনের বাইরে থাকবে- এটি অপ্রত্যাশিত। অন্য দিকে রাজধানীর প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে অধ্যয়নরত অনেক শিক্ষার্থী করোনার শুরুর দিকেই গ্রামে চলে গেছে। তাড়াতাড়ি এসব শিক্ষার্থীর আবার ঢাকায় ফেরারও সম্ভাবনা নেই। ফলে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া এসব শিক্ষার্থীর বড় একটি অংশই ঝরে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থী ভর্তিতে ভাটা চলছে। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতির পক্ষ থেকেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ২০ আগস্ট রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত ছিল একাদশে ভর্তির প্রথম ধাপে আবেদনের শেষ তারিখ। ওই দিন সারা দেশের ১৩ লাখ ৪২ হাজারের মতো শিক্ষার্থী আবেদন করেছে। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ জানান, প্রথম ধাপে ২ লাখ ৫১ হাজার শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির আবেদনই করেনি। তিনি আরো জানান, এ বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি শিক্ষার্থী ঝরে পড়া প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে জানান, করোনা পরিস্থিতিতে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী রাজধানী ছেড়েছে। অভিভাবকদের মধ্যে কেউ জানিয়ে টিসি নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ না জানিয়ে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে নবম শ্রেণীর রেজিস্ট্রেশন শুরু হলেও অনেক শিক্ষার্থীকেই পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে অনলাইন ক্লাসেও অংশ নিচ্ছে না। আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। করোনার এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির পরিসংখ্যানে দেখা যায় সেখানে গত বছরের সামার ও ফল এই দুই সেমিস্টারে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল প্রায় এক হাজার। করোনার প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির চলতি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ভর্তিতে ধস নেমেছে। সামার ও ফল- এ দুই সেমিস্টার মিলে এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে আড়াই শ’র কিছু বেশি। আর শিক্ষার্থী ভর্তির এই চিত্র প্রায় সব ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। করোনার কারণে শিক্ষার্থী ভর্তির হার এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। অবশ্য বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এই ধসের কথা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির পক্ষ থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে।
সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন জানান, বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। দু-চারটি ব্যতিক্রম এবং শীর্ষ পর্যায়ের হাতেগোনা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আসন অনুপাতে শিক্ষার্থী পেয়েছে। এ ছাড়া সবাই শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে বড় সঙ্কটে রয়েছে। প্রাথমিক একটি হিসাবে দেখা গেছে, বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা গড়ে ৫০ শতাংশের মতো কমেছে। আবার কোথাও ৮০-৯০ শতাংশও কমেছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে করোনার এই মহামারীতে উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবারের আর্থিক সঙ্কট, রাজধানীর বাইরে অবস্থান সর্বোপরি করোনায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে শিক্ষার্থীরা এখন ভর্তি হতে চাচ্ছে না।
এ দিকে করোনার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে গ্রাম ও শহর উভয় এলাকায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম ২৫ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেন। বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের কাছে আসা এমন তথ্যের ভিত্তিতে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেকোনো সময়ে যেকোনো ক্লাসেই বিনা টিসিতে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম আল হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এমন নির্দেশনা জারি করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান।
সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্র্যাকের এডুকেশন প্রোগ্রামের আওতায় পরিচালিত এক জরিপেও দেখানো হয় যে, করোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থী তাদের মা-বাবার সাথে গ্রামে চলে যাচ্ছে। ফলে গ্রামের স্কুলে শিক্ষার্থীদের চাপ বাড়ার একটি আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে সংস্থাটি এমন আশঙ্কাও করছে যে, করোনার পর অভাবের তাড়নায় অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া বাদ দেবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব পর্যায়েই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আগামী দিনে গ্রামের স্কুলগুলোতে ক্লাসরুম তথা ভবন বাড়াতেও ব্র্যাকের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।