দিগন্তের আলো ডেস্ক :-
নতুন মৌসুমকে সামনে রেখে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে চালু হয়েছে ৪৬টি ইটভাটা। এর মধ্যে বৈধ কাগজপত্রসহ অনুমোদন রয়েছে ২টি ভাটার। ২২টি ভাটা মহামান্য হাইকোর্টে মালিকপক্ষের এক রীটের রায়ের প্রেক্ষিতে ছয়মাসের সাময়িক অনুমতি পেয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। ৪টি ভাটার কার্যক্রম অন্য একটি রীটের আদেশে একমাসের জন্য কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। অবশিষ্ট্য ১৮টি ভাটার নেই কোন ধরনের বৈধ কাগজপত্র কিংবা অনুমোদন। এগুলোর মধ্যে ১২টি ভাটায় জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কয়লা এবং বাকিগুলোতে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
এর মধ্যে চররমিজ ইউনিয়নের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ন এলাকায় রয়েছে ২৩টি ইটভাটা। এছাড়াও চরবাদামে ১টি, চরপোড়াগাছায় ৩টি, চরআলগীতে ৯টি ইটভাটা রয়েছে। এছাড়াও চররমিজ ইউনিয়নের চরআফজল গ্রামে ৭টি ইটভাটা নতুন করে চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। প্রায় প্রতিটি ইটভাটাই স্থাপন করা হয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কৃষিজমিতে। প্রতিটি ইটভাটার জন্য প্রয়োজন হয় ন্যূনতম ৫একর জমি। এ হিসেবে উপজেলার ৪৬টি ইটভাটার জন্য মোট কৃষিজমির ব্যবহার হয়েছে ২শ ৩০একর জমি। ছোট একটি উপজেলা হিসেবে প্রায় অর্ধশতাধিক ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনাকে অস্বাভাবিক বলছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও কাঠ পোড়ানোর ফলে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ার আশংকা করছেন তারা।
স্থানীয়ভাবে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রামগতি উপজেলায় ৮টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। সুুবিশাল মেঘনা ও ভুলুয়া নদী বেষ্টিত উপজেলা হওয়ায় সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ ও স্বল্পমূল্যে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে উপজেলার চর বাদাম, চরপোড়াগাছা, চরআলগী, চররমিজ, বড়খেরী ও চরগাজীতে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক ইটভাটা। চলতি মৌসুমে ইটভাটাগুলো চালু না করার দাবিতে উপজেলার চরগাজী ও চররমিজ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি স্থানে স্থানীয় বাসিন্দারা করছেন মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার দাবিতে পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিকট ইতিমধ্যে স্থানীয়রা বেশ কয়েকবার স্মারকলিপি ও গণআবেদন জমা দিয়েছেন।
ভাটা মালিকরা চলচাতুরিতেও বেশ পারঙ্গম। কাঠ পোড়ানো ভাটাগুলোর মধ্যে ৬টি ভাটায় কয়লা ব্যবহারের চিমনি তৈরি করে বাহ্যিকভাবে প্রদর্শন করা হলেও আড়ালে পোড়ানে হবে কাঠ। মূলত প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলকে ফাঁকি দিতেই এমন অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
জনসাধারনের ব্যাপক দাবির প্রেক্ষিতে মৌসুম শুরুর আগেই জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে একাধিক অভিযান পরিচালনা করে ৭টি নির্মানাধীন (মৌসুমে চালুর প্রক্রিয়া) ভাটা পূর্নাঙ্গভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। গুড়িয়ে দেওয়ার পর রাতের আধাঁরে প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেগুলোও পুনরায় চালু করার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
চরগাজী ইউনিয়নের চরআফজল টুমচর এলাকায় বাড়ির দু পাশে একাধিক কাঁচা ইটভাটা বন্ধের দাবিতে জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা বরাবর আবেদনপত্র জমা দেওয়া দিয়েছেন আজাদ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইব্রাহিম খলিল। ভুক্তভোগি এ শিক্ষক জানান, অবৈধ ভাটা বন্ধে বিভিন্ন স্থানে দরখাস্ত দেওয়ায় আমাকে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, আমার বাড়ির চারপাশেই অবৈধ ইটভাটা। এসব ভাটার প্রভাবে বাড়ির নারিকেল, সুপারিগাছগুলো মরে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পাতাগুলো শুকিয়ে গেছে। নারিকেলে পানি কিংবা শাস থাকেনা। ক্ষেতে ফসল ও সবজি আবাদ হয় না। ফসল বুনলেই গাছে জট ধরে যায়। এছাড়াও পবিবারের সদস্যদের শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও খোসপাঁচড়া, চর্মরোগ ও এলার্জি সমস্যা তো আছেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রিয় সমন্বয়ক ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন গত কয়েকদিন আগে পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা বরাবর রামগতি উপজেলার অবৈধ সকল ইটভাটা বন্ধ করার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। রাকিব হোসেন বলেন, তার আবেদনের ফলেই পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ রিজওয়ানা চৌধুরী একটি অনুষ্ঠানে রামগতি উপজেলার একটি গ্রামে ১৮টি ইটভাটা আছে এমন বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি আশা করেন খুব দ্রুতই অবৈধ ইটভাটা বন্ধের বিষয়ে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধের দাবিতে আমি লড়াই করছি। এ বিষয়ে যা করার সব প্রচেষ্টাই করবো।
ইটভাটা মালিক সমিতির সদস্য ও ভাটা মালিক শাহেদ আলী মনু জানান, মালিক সমিতির ২২ সদস্য মিলে আমরা মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছি। একাধিক শুনানী শেষে আদালত তাদেরকে বাংলাভাটা হিসেবে চলমান মৌসুমটি শেষ করার অনুমতি হিসেবে আমাদেরকে ৬মাস ভাটা পরিচালনার সময় দিয়েছেন। রীটের বাহিরে থাকা অবশিষ্ট ইটভাটাসমূহ কীভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে যে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারছেন না। ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছানাউল্যা ছানুর সাথে এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলায় প্রায় দেড় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই অবৈধভাবে স্থাপিত হয়েছে। এরমধ্যে শুধু রামগতি উপজেলায় রয়েছে ৫০টি ইটভাটা। জেলা অধিদপ্তরের সূত্রমতে, চলতি মৌসুমে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে রামগতি উপজেলার ২৫টি ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়েছে। এসব ভাটার মধ্যে ১৩টির মালিককে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় ২১লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অন্য ১২টি ভাটার কোন ধরনের কাগজপত্র না থাকায় চিমনিসহ ভাঙ্গাসহ ভেকুমেশিন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযান পরিচালনার নেতৃত্ব দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেড কাজী তামজিদ আহমেদ ও সুলতানা সালেহা সুমি এবং লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো: হারুনুর রশিদ পাঠান।
লক্ষ্মীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো: হারুনুর রশিদ পাঠান জানান, দেশব্যাপি অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এর ফলে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসন যে পদক্ষেপ নিবেন সে সাথে আমরাও সমন্বয় করবো। এর বাহিরে অতীতের মতো আমাদের এককভাবে অভিযান পরিচালনা করার সুযোগ নেই।