বিতর্কিতরা বাদ যাচ্ছে

বাংলাদেশ

 

দিগন্তের আলো ডেস্ক :

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি থেকে বাদ যাচ্ছে বিতর্কিত, দুর্নীতিবাজ, ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট নেতারা। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরও কমিটিতে না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, গত নগর কমিটির কয়েকজন নেতা ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এছাড়া সাবেক ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা কাউন্সিলর হয়েছেন। তারা এবার নগরের কমিটিতে পদ পেতে দৌড়ঝাপ করছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাদের কাউকেই এবার কমিটিতে রাখা হবে না। আর নগরের বিতর্কিত কয়েকজন নেতা যেমন-সাবেক সহ-সভাপতি আওলাদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক হেদায়েতুল ইসলাম স্বপন, কোষাধ্যক্ষ ইমতিয়াজ জামিল লাভলুকে কমিটিতে রাখা হচ্ছে না। এছাড়াও যারা ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট, দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় তাদেরকেও বাদ দেয়া হচ্ছে।

তাদের স্থলে দলের ত্যাগী ও যোগ্য, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, এক এগারোর সময় আওয়ামী লীগ সভাপতির মুক্তির আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন এমন নেতাদের মহানগর কমিটিতে স্থান দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনায় মহানগর সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি এবং হুমায়ুন কবির ইতোমধ্যে নগর কমিটির খসড়া প্রস্তুত করেছেন। এখন চলছে শেষ মুহুর্তের চুলচেরা বিশ্লেষণ। গত বৃহস্পতিবার রাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এনিয়ে বৈঠকও হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন কবির, ঢাকা উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। বৈঠকে মহানগর নেতারা জানান, কোন ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে মহানগর কমিটিতে রাখতে প্রধানমন্ত্রী নিষেধ করেছেন।

মহানগরের সাবেক সহ-সভাপতি আওলাদ হোসেন ঢাকা দক্ষিণের রাজনীতি নষ্ট করার জন্য অন্যতম ক্রীড়ানড়ক হিসেবে জানিয়েছেন নগরের সিনিয়র নেতারা। তিনি এক সময় ছিলেন মায়া চৌধুরীর লোক, আবার নেতা পরিবর্তন করে মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। মেয়র হানিফকে ত্যাগ করে আবার মায়া চৌধুরীর কাছেও এসেছেন। শাহে আলম মুরাদের বিরোধীতা করেও আবার তারই আপন জনে পরিণত হন সে নেতা। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যত রকমের অভ্যন্তরীন মেকানিজম রয়েছে তার মূল ক্রীড়ানড়ক। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি সংগঠনকে যেমন বিতর্কিত করেছেন তেমনি নগরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও ঘোল খায়িয়েছেন বহুবার। সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদকে বিতর্কিত করার মূল অপকর্মকারী নেতা আওলাদ। কিন্তু নানা অপকর্ম করেও এখনো বহাল তবিয়তে তিনি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ‘ভাইরাস’ খ্যাত এই নেতাকে নিয়ে নগরের সকল নেতাই বিরক্ত। তাই তাকে এবার নগর কমিটিতে রাখা হচ্ছে না।

কোন ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য না করলেও শত কোটি টাকার মালিক আওলাদ। মতিঝিল মডেল স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি থেকে দুর্নীতির দায়ে বিতাড়িত হয়েছেন আওলাদ হোসেন। ঢাকা একাধিক বাড়ি রয়েছে তার। ৪০৫, গুলবাগে ১২ তলা বাড়ি; ২৭৮ গুলবাগের বাড়ি, ধানমন্ডি ৪ নম্বর রোডে একটি বিলাস বহুল বাড়িতে ফ্ল্যাট, শান্তিনগরে মার্কেট রয়েছে এই নেতার। দুদক একাধকবার তদন্ত করলেও অজানা কারণে শেষ সমাপ্তি হয়নি।১০ বছর মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন আওলাদ হোসেন। শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য, এমপিও প্রদান ও তহবিল তছরুপসহ নানা অভিযোগ তুলে সভাপতি আওলাদ হোসেনের অপসারণ চেয়ে স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও গভর্নিং বডির সব সদস্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ করেছিলেন। এতে তারা বলেছিলেন, গত ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি আওলাদ হোসেন কলেজ ফান্ডের গচ্ছিত টাকা লুটপাট করে নিজে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এতে প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সভাপতি টাকার বিনিময়ে ২০০ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। সভাপতি সব শিক্ষকদের হয়রানি করেন। কথা না শুনলে প্রতিষ্ঠানটিতে টর্চার সেল হিসেবে খ্যাত একটি কক্ষে শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত ও মামলা হামলার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। সে সময় শিক্ষক অভিভাবকদের আন্দোলনে ক্যাসিনো খালেদবাহিনী দিয়ে দুই বার হামলাও চালান আওলাদ। পরবর্তীতে তাকে অবাঞ্চিত করে তার রুমে তালা লাগিয়ে দেয় অভিভাবকরা। এবং তিনি স্কুলের গাড়িতে করে স্কুলে আসলে গাড়ির চাবি রেখে দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়।

আওলাদ হোসেনের হাত ধরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন থানা ওয়ার্ডে সন্ত্রাসী ও ক্যাসিনো কারবারিরা পদ পেয়েছে। গেন্ডারিয়া থানার এনু-রুপম দুই ভাই আওলাদ হোসেনের মাধ্যমেই পদ পেয়েছে। সাথে সহযোগিতা করেছে সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হেদায়েতুল ইসলাম স্বপন। তাই স্বপনকেও বাদ দেয়া হচ্ছে কমিটি থেকে।
এছাড়া মতিঝিল ও শাহজাহানপুরে আধিপত্য বজায় রাখতে আন্ডারওয়াল্ডের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই গভীর। একসময় এই এলাকার সন্ত্রাসী মানিকের সঙ্গে ছিল তার সখ্যতা। এরপর যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূইয়ার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখেন। খালেদের পর এখন অঘোষিতভাবে খালেদের শিষ্যদের আশ্রয় দিচ্ছেন তিনি।

নিজের আধিপত্য ঠিক রাখতে নিজ এলাকা শাহজাহানপুরের দুই ওয়ার্ডে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের পরাজিত করতে ভূমিকা নেন আওলাদ। শুধু ওয়ার্ড কাউন্সিলর নয়, বর্তমান মেয়র ব্যরিস্টার ফজলে নূর তাপসও এই এলাকায় ভোটে ফেল করেন। এখানে ১২ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মামুনুর রশিদ শুভ্র পাস করে এবং মহিলা কাউন্সিলররা পাস করে। কিন্তু মেয়র ও কাউন্সিলর উভয়ই ফেল করে। স্থানীয় এ মেকানিজমে আওলাদের সঙ্গী ছিল নগরের কোষাধ্যক্ষ ইমতিয়াজ জামিল লাভলু, মতিঝিল থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুু। তাই এই দুই নেতাকেও বাদ দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরসহ নগরের বেশিরভাগ নেতাই আওলাদ হোসেনকে পছন্দ করেন না। নেতাদের মতে, রাজনীতির এই ‘ভাইরাস’কে নগরে পদ দেয়া হলে রাজনীতি নষ্ট হবে। ২০১৭ সালে আওলাদ হোসেনকে মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি মনোনয়নে আপত্তি জানিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও থানার ২১ জন নেতা। এর মধ্যে রয়েছেন, তৎকালীন কমিটির সহ-সভাপতি ও বর্তমান কাউন্সির আবুল বাশার, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামাল চৌধুরী ও ডা. দীলিপ রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাড. তাহমিনা বেগম, সহ-প্রচার সম্পাদক মামুনুর রশিদ শুভ্রসহ নেতারা।

নিজের ক্ষমতা ঠিক রাখতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের উপর ভর করেন আওলাদ। ১১ নং ওয়ার্ডে বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করেন এবং ১২ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মামুনুর রশিদ শুভ্রকে বিজয়ী করেন। বর্তমানে শুভ্রর মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব আওলাদ হোসেনের। তৈরী করেছেন ক্যাডার বাহিনী। ক্যাডাররা শিপু, বড় বাবু, সেলিম, কানা বাবুল, কানা মতিন, লাল মিয়া, আরিফ, আবির, সাদেকের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে পথে ঘাটে চাঁদাবাজির বন্দোবস্তো করেছেন আওলাদ ও কাউন্সিলর মামুনুর রশিদ শুভ্র।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেছেন, কোন বিতর্কিত লোককে মহানগর কমিটিতে স্থান দেয়া হবে না। মহানগর কমিটি হবে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। ত্যাগী, যোগ্য ও এক-এগারোর সময় মাঠে ছিলেন এমন নেতারা স্থান পাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *