বন্যায় ১৮ হাজার খামারির ৪০ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

লক্ষ্মীপুর

 

দিগন্তের আলো ডেস্ক :-

লক্ষ্মীপুরে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও পরবর্তীতে বন্যার পানিতে চাষকৃত ৪০ হাজার ১২৫টি মাছের পুকুর-জলাশয় ডুবে যায়। পুকুর-জলাশয়ের ওপরেই তিন-চার ফুট পানি ছিল। এতে খামারিরা চেষ্টা করলেও ঘেরের মাছ আটকে রাখতে পারেননি। স্রোতের সঙ্গে ঘেরের ছোট-বড় সব মাছ ভেসে গেছে। খামারিদের দাবি, পর্যাপ্ত জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পানির স্রোত পেলে মাছ যেভাবেই হোক চলে যায়। চোখের সামনেই সব মাছ ভেসে গেছে।

লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যায় প্রায় ১৮ হাজার খামারির ৪০ হাজার ১২৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় মৎস্য চাষীদের।

এ বন্যায় মৎস্য চাষি গাজী মোহাম্মদ বেলাল, মামুনুর রশিদ ও ইঞ্জিনিয়ার এটিএম হাসান মাহমুদ সোহাগের প্রায় ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। মাছ ভেসে গিয়ে তাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন তারা। মাছ চাষই তাদের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। চাষকৃত মাছ ভেসে গিয়ে এখন তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। এমতাবস্থায় সরকারের সহযোগিতা ছাড়া তাদের ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব।

সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের আটিয়াতলি এলাকার মৎস্য চাষি হাসান মাহমুদ সোহাগ পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তিন বছর আগে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু এ বন্যায় তার প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব বলে মনে করছেন তিনি। তার পাঁচ একর জমিতে মাছের প্রজেক্টটি রয়েছে। এ ছাড়া আলাদা একটা পুকুরও আছে। পুকুরটিতে মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়। পরে প্রজেক্টে এনে ফেলা হয়।

জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, বন্যায় প্রায় ৩৫ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে। এরমধ্যে ৫ হাজার রুই, ২ হাজার মৃগেল ছিল। প্রত্যেকটি মাছ প্রায় এক কেজি ওজনের ছিল। আমি ছোট মাছ কখনো বিক্রি করিনি। সবসময় বড় মাছ বাজারজাত করি। রুই আর মৃগেলেই প্রায় ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া কাতল, পাংগাস, তেলাপিয়া, টেংরা, শিং ও কার্পজাতীয় মাছ ছিল। আমি মিশ্র মাছ চাষ করি। টানা বৃষ্টিতে প্রথমে প্রজেক্ট ডুবে মাছ চলে যায়। এরপরও কিছু মাছ ছিল। কিন্তু পরে বন্যাতে সবগুলো মাছ চলে গেছে। পানি দূষিত হওয়ায় যে কয়টি মাছ ছিল তাও মরে গেছে। দুই ধাপে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

সোহাগ আরও বলেন, পুকুর চাষাবাদের উপযোগী করতে পানিতে ১৮ হাজার টাকার কীটনাশক ছিটিয়েছি। এরপর উঁকুনের ওষুধ দিয়ে পানি শোধন করতে হবে। প্রথমবার দিয়েছি। একসপ্তাহ পরে আবার উঁকুনের ওষুধ দিতে হবে। পুনরায় মাছ চাষ করতে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। মাছ চাষই আমার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। কৃষি ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা ও যুব উন্নয়নে ২ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া খাদ্যের দোকানে বাকি আছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ টাকা পরিশোধ নিয়েই আমি চিন্তায় আছি। সব টাকা প্রজেক্টে খরচ হয়েছে। মাছ ভেসে গিয়ে সব শেষ হয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানোর মতো কোনো সুযোগ দেখছি না। হতাশার মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে, কি করবো তা বুঝে উঠতে পারছি না।

বন্যায় দত্তপাড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম বটতলি গ্রামের মৎস্য চাষি মামুনুর রশিদের প্রায় ১৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে তিনি ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেননি। পারিবারিকভাবেই তারা মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। তাদের উপার্জনের প্রধান উৎস হচ্ছে মাছ চাষ। পুঁজির সকল টাকা একটি জলাশয় ও তিনটি পুকুরে মাছ চাষ করে বিনিয়োগ করেছেন। বন্যায় সকল মাছ ভেসে চলে গেছে। তারা মিশ্র মাছ চাষ করতেন। রুই-কাতল, মৃগেল-তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল।

জানতে চাইলে মামুনুর রশিদ বলেন, চোখের সামনে সবগুলো মাছ বন্যার পানিতে ভেসে চলে গেছে। শুধু তাকিয়েই ছিলাম, কিছু করার ছিল না। দুই বছরের পুরোনো কিছু মাছ ছিল। সব মাছ চলে গেল। এখন প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। পুকুরের পাশে সমতল জমিতেও প্রায় কোমর পরিমাণ পানি ছিল। চেষ্টা করেছি মাছ আটকানোর, কিন্তু পারিনি। আমরা যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পেলে এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। চাষাবাদ করতে কখনো ঋণ নিতে হয়নি, তবে এবার নিতে হবে। এ বন্যায় আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে আমার।

লাহারকান্দি ইউনিয়নের চাঁদখালী গ্রামের গাজী মোহাম্মাদ বেলাল ও তার ভাই যৌথভাবে ১১ একর জমিতে পুকুর কেটে মিশ্র মাছ চাষ করে আসছেন। এটিই তাদের প্রধান ব্যবসা। এ বন্যায় তাদের প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত জাল ছিল। জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। অনেক বেশি পানি ও স্রোতের কারণে সব মাছ চলে গেছে।

গাজী মোহাম্মদ বেলাল বলেন, মাছচাষ আমাদের প্রধান ব্যবসা। বন্যায় আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সরকারিভাবে আমাদের কোনো সহযোগিতা করলে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সহজ হবে। রুই, কাতল, মৃগেল ও কার্পজাতীয় প্রায় ৩০ লাখ টাকার মাছ ছিল। অনুমান করছি এখন কিছু মাছ আছে। আগে খাবার দিলে যে পরিমাণ মাছ লাফালাফি করতো। এখন তেমনটা দেখা যায় না। ভেসে যাওয়া মাছের মধ্যে ২ কেজি ওজনের তেলাপিয়া, দেড় থেকে ২ কেজি ওজনের পাঙ্গাস-রুই ছিল। পুকুরের বাইরেও প্রায় তিন-চার ফুট উচ্চতার পানি ছিল। প্রায় একমাস ধরে পানিতে ডুবেছিল খামার।

তিনি আরও বলেন, আমরা ফাল্গুনে মাছ ফেলেছি। ভাদ্র মাসে বন্যা হয়। মাছের খাবারেই প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মাছ যখন বড় হয়েছে, বিক্রির উপযোগী হয়েছে। তখনই বন্যায় সব চলে গেছে। এতে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যদি বন্যায় মাছ ফেলার শুরুতে হতো। তাহলে খাবারে কম খরচ হতো, মাছও ছোট ছিল। এতে ক্ষতিও কম হতো। সরকারিভাবে একটি তালিকা নিয়েছে। কোনো সহযোগিতা পেলে আমরা উপকৃত হবো।

লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, বন্যায় প্রায় ১৮ হাজার খামারির ৪০ হাজার ১২৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় মৎস্য চাষীদের। ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০ লাখ টাকার পোনা মাছের বরাদ্দ পেয়েছি। সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

প্রসঙ্গত, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, দত্তপাড়া, বাঙ্গাখাঁ, চন্দ্রগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা। প্রথম দিকে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে ডুবে যায় পুকুর-জলাশয় ক্ষেত-খামার, গ্রামীণ রাস্তাসহ মানুষের বসতঘর। এরমধ্যে নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরে। এতে পানি দ্বিগুণ উচ্চতা ধারণ করে। পুনরায় ডুবে যায় পুকুর-জলাশয়, রাস্তা-ঘাট, বসতঘর ও ফসলি জমিগুলো। এখনো বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে রয়েছে। কোথাও কোথাও দুই মাস ধরেই পানিতে তলিয়ে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *