দিগন্তের আলো ডেস্ক :
এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকলেও শিক্ষার্থীদের পরিশোধ করতে হচ্ছে সকল ফি। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবকদের চাপ দিয়ে ফি আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত নভেম্বরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নিতে পারবে। কিন্তু টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন বাবদ এবং অ্যাসাইনমেন্ট সংক্রান্ত কোনো ফি নেয়া যাবে না। এ ছাড়াও যেসব অভিভাবকদের করোনাকালে অবস্থা শোচনীয় তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার কথা বলা হয়। এরআগে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একাধিকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতনের বিষয়টি সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন।
কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি।
আবার অভিভাবকদের মাঝেও দেখা গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন না দেয়ার প্রবণতা। অভিযোগ আছে, রাজধানীর ওআইডব্লিইউসি স্কুলে সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রিএডমিশন ফি নেয়া হয়েছে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়াও প্রতিমাসে নেয়া হচ্ছে পূর্বের ন্যায় ১৬০০ টাকা করে মাসিক বেতন। সরকারি নির্দেশনায় বলা হলেও নেয়া হচ্ছে সকল ধরনের ফি। এই স্কুলটির মতো রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায় একইভাবে বেতন, ভর্তি ফিসহ আনুষঙ্গিক সকল অর্থ নেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজ, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ, মর্নিং সাইন স্কুল, ন্যাশনাল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজ, ব্রিটেনিয়া স্কুল এন্ড কলেজ, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা, প্রিমিয়ার স্কুল ঢাকা, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার ও বোস্টন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ছাড়াও আরো নামকরা অনেক স্কুলের বিরুদ্ধে অভিভাবকরা অভিযোগ করছেন।
ওআইডব্লিইউসি স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আলিম খান বলেন, সরকারি নির্দেশনার পরেও ওই স্কুল এক টাকাও কমায়নি। আমরা আন্দোলন করেছি, স্মারকলিপি দিয়েছি কিন্তু কোনোভাবেই কোনো উপকারে আসেনি।
অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জেসমিন জারা বলেন, আমার ছেলে এবার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার প্রতিমাসে বেতন বাবদ স্কুলে দিতে হয় ৩২০০ টাকা। করোনা আসার আগেও একই পরিমাণ অর্থ দিতে হতো। সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রিএডমিশন ফি নিয়েছে ১৬০০০ টাকা।
এসবের বাইরে ২০২১ সালের এসএসসি’র ফরম পূরণে রাখা হচ্ছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ অর্থ। অধিক অর্থ আদায় করা যাবে না এমন নির্দেশনা দেয়ার পরেও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানবিকতার পরিচয়ও দিয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মনিপুর স্কুল এন্ড কলেজের অভিভাবক আল মিজান করোনাকালে চাকরি হারিয়েছিলেন। পরিবার নিয়ে মাগুরায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। পুনরায় চাকরি পাওয়ায় ঢাকায় ফেরেন তিনি। বলেন, ভেবেছিলাম আর ঢাকায় আসা হবে না। এরপর চাকরি পেলাম আবার। স্কুলে যোগাযোগ করে জানতে পারি ৯ হাজার টাকা বকেয়া হয়েছে। অবস্থা জানিয়ে আবেদন করার পর তারা চার হাজার টাকা মওকুফ করে দেয়।
সার্বিক বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, আমরা অভিভাবকরা আসলে অসহায়। আমরা বলেছিলাম, যেহেতু শিক্ষার্থীরা সরাসরি শিক্ষা নিতে পারছে না সেহেতু ৫০ শতাংশ কমানো হোক। একাধিকবার দাবি জানানোর পরে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন শুধুমাত্র আনুষঙ্গিক অর্থ বন্ধ নেয়া হবে না। কিন্তু সেটাও মানা হচ্ছে না স্কুলগুলোতে। আমরা অভিভাবকরা নির্যাতিত। এর কারণ হচ্ছে মাউশি থেকে কোনো মনিটরিং করা হয় না। নেই কোনো জবাবদিহি। তারা নির্দেশনা দিলেন তাদের বেঁধে দেয়া অর্থ আদায় করতে হবে। নির্দেশনা দিয়েও কোনো স্কুল তা মানে না। তাহলে এই নির্দেশনার প্রয়োজন কি?
তবে রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর শোচনীয় অবস্থা। মিলন আহমেদ একজন ওষুধ ব্যবসায়ী। তার দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে পড়তো অর্কিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। আদাবরে অবস্থিত স্কুলটিতে প্রথম শ্রেণিতে পুরো বছর বেতন দিলেও এ বছর আর দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, মেয়ের স্কুলে যাওয়ার বয়স হইলো আর করোনা শুরু হইলো। শুরুতে কয়েকটা দিন স্কুলে যায়। এরপর থেকে ওর মায়ের কাছে যা শেখার শিখছে। তাহলে স্কুলে অর্থ পাঠানোর প্রয়োজন দেখছি না।
আবার অভিযোগ আছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার ঘটনা ঘটলেও বঞ্চিত করা হচ্ছে শিক্ষকদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থী ২০২০ সালে ছিল ৭৪২ জন। এ বছর তা কমে হয়েছে ৬৯২ জনে। তবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু আমাদের বেতন দেয়া হয় না ঠিকমতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর ঠিকমতোই দেয়া হতো বেতন। এরপর অক্টোবর মাস থেকে ডিসেম্বরে বেতনই দেয়া হয়নি। এরপর অর্থ দেয়া হয়। হিসাব করে দেখলে তিন মাসের বেতনের ৪০ শতাংশ করে হয় তা। আর এখন ২৫ শতাংশ কম করে বেতন দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ কিন্ডার গার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকরা করুণ অবস্থার মধ্যে আছে। অধিকাংশ স্কুলে যেখানে বেতন আদায় করতে পারছি সেখানে ৬০ শতাংশ অর্থ আদায় করছি। আর কেউ যদি বেতন ওঠানোর পরেও যদি শিক্ষকদের বেতন না দিয়ে থাকেন তবে সেটা অমানবিক। আমরা জানলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। আমাদের দেশব্যাপী শিক্ষকদের এমনই অবস্থা হয়েছে যে আমাদের শিক্ষকদের অর্থ সহযোগিতা দেয়ার জন্য আবেদন জানিয়ে আসছি আমরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশি’র মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, করোনার সময়ে শিক্ষক, অভিভাবক দুই শ্রেণিই ক্ষতিগ্রস্ত। তাই আমরা একটা সমন্বয়ের ব্যবস্থা করেছি। এরপরও যদি অতিরিক্ত ফি আদায় করে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।