ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নিহত গৃহবধূ মর্গের সামনে বসে মায়ের জন্য দুই শিশুর কান্না

অপরাদ

 

দিগন্তের আলো ডেস্ক :
শাহরিয়ার ও তামিমার কোনো দিন ঢাকা শহর দেখা হয়নি। সিলেটের বাড়ি থেকে ফরিদপুর বেড়াতে যাওয়ার সুযোগে তাদের ঢাকা দেখা হয়। বাবা মাকে নিয়ে তারা ওঠে ঢাকার এক আত্মীয়ের বাসায়। শনিবার সকালে ট্রেনে চড়ে সিলেটে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। তারা সিলেটে গিয়েছেন কিন্তু মাকে আর জীবিত নিয়ে যেতে পারেনি। লাশ হয়ে কফিনে যেতে হয়েছে তাদের মাকে। ঝকমকে এই ঢাকা শহরের ছিনতাইকারীরা তাকে জীবিত ফিরতে দেয়নি। আজ শনিবার ভোরে মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর কমলাপুরের টিটিপাড়া এলাকায়। নিহতের নাম তারিনা বেগম লিপা (৩৮)।

যে শিশুদের আজ সকালে ট্রেনে থাকার কথা ছিল সেই শিশুদের থাকতে হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে। তখন মায়ের লাশ মর্গের ভেতর। মাকে হারিয়ে মর্গের সামনে দুই শিশুর কান্নায় অন্য রকম এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে শাহরিয়ার। পরীক্ষা শেষে ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাদের বাবা গোলাম কিবরিয়া। সেই অনুযায়ী গত মঙ্গলবার তিনি তার স্ত্রী তারিনা বেগম ছেলে শাহরিয়ার বিনতে কিবরিয়া ও মেয়ে তামিমা বিনতে কিবরিয়া ওরফে নাজিফাকে নিয়ে ফরিদপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হন। সেখান থেকে তারা প্রথমে ঢাকার সবুজবাগের রাজারবাগের কদমতলা এলাকার আবু তাহের ইয়াসিনের বাড়িতে আসেন। সেখান এক রাত থেকে ফরিদপুরের আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে যান। ফরিদপুর থেকে আবারো সিলেটে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিয়ে কিবরিয়া পরিবার শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ঢাকায় ইয়াসিনের বাড়িতে আসেন। সেখান থেকে আজ শনিবার ভোর সোয়া পাচটার দিকে তারা সিলেটের পারাবত ট্রেন ধরার জন্য রওয়ানা হন। সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ার সময় ছিল। দুটো রিকশায় ওঠেন তারা। সামনের রিকশাতে ছিলেন নিহত লিপা ও তার ছেলে শাহরিয়ার। পেছনের রিক্সায় ছিলেন গোলাম কিবরিয়া ও তার তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা তামিমা নাজিফা।

তাদের বহনকরা রিকশা দুটো কমলাপুর স্টেশনের আগে টিটিপাড়া এলাকা পার হওয়ার সময়ই পেছন থেকে একটি সাদা প্রাইভেটকার আসে। প্রাইভেটকারটি এসে তারিনা ও শাহরিয়ারকে বহনকারী রিকশার পাশে এসে গতি কমায়। এ সময় প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে একজন উপরের দিকে ওঠে তারিনার কাধে ঝুলানো ব্যাগ ধরে টান দিয়ে নিয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই তারিনা রিকশা থেকে পরে যান নিচে। তিনি মাথা, নাক মুখে আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত হন। এ সময় বাবা ও ছেলে তারিনাকে কাধে তোলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তারিনার রক্তে স্বামী ও সন্তানের শার্ট ভিজে যায়। আর তখন ছোট্ট শিশু তামিমা গগণ বিদারী চিৎকার করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সেখানে উপস্থিত হয় পুলিশ। তারা তারিনা বেগমকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওপার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তার লাশ ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়।

আজ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গের সামনে গিয়ে দেখা যায় তামিমা ও শাহরিয়ার পাশাপাশি বসে কাদছে। তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে তাদের এক আত্মীয়। কিন্তু কোন সান্ত্বনাই কাজে লাগছে না। আর তাদের বাবা গোলাম কিবরিয়া রক্তমাখা শার্ট গায়ে একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে কাদছেন। এ সময় সেখানকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।

শাহরিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, আমার এসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ায় বাবা মা আমাদেরকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মাকে আর বাড়ি নিয়ে যেতে পারলাম না।

এক প্রশ্নের জবাবে শাহিরায়ার জানায়, জীবনের প্রথমবার তার মা, সে ও তার বোন ঢাকায় এসেছিল। সে আরো জানায়, প্রাইভেটকারে দু’জন ছিল। একজন চালাচ্ছিল। আরেকজন টান দিয়ে তার মায়ের ব্যাগটি নিয়ে যায়।

বাবা গোলাম কিবরিয়া সিলেটের মোগলাবাজার জালালপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি এক সময় বিদেশে ছিলেন। কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে ব্যবসা করছেন।

গোলাম কিবরিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, আমার স্ত্রী খুব ভালো মনে মানুষ ছিল। বেড়াতে এসে তাকে হারাবো ভাবতেই পারছি না। নিজেকে অপরাধী লাগছে।

সবুজবাগের বাড়ির আত্মীয় আবু তাহের ইয়াসিন বলেন, আমার বাড়িতে তারা বেড়াতে এসেছিল। কিন্তু তারিনা লাশ হয়ে যাওয়ার কারনে বেশ কষ্ট পাচ্ছি। আমাদের এই ঢাকা শহর কি এভাবেই চলবে। কেউ কি নিরাপদে চলতে পারবে না? এই ছোট্ট শিশুটিকে কি দিয়ে বুঝাবো আমরা।

আবু তাহের জানান, ঘটনার পর যে রিকশা চালক তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি তার বাড়িতে ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা দুটো ব্যাগ নিয়ে তার বাড়ি যান। পরে রিকশা চালককে ভাড়া দিতে চাইলেও তিনি ভাড়া না নিয়ে চলে যান।

এ ঘটনায় মুগদা থানায় মামলা হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তারিনার স্বামী গোলাম কিবরিয়া। এ বিষয়ে মুগদা থানার ওসি প্রলয় কুমার সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ছিনতাইকারীদের ধরতে আমাদের কয়েকটি টিম কাজ করছে।
কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *