দিগন্তের আলো ডেস্ক :
নারী অধিকার রক্ষায় ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মসূচি চলমান থাকলেও খুলনায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা। গত ১১ বছরে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ১১০টি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) আইন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৭০৬ বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে খুলনায় ৩০১টি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। তাদের তথ্যমতে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনায় এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা। বিচ্ছেদকারীদের বেশিরভাগ ২৫ বছর থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে। এই বয়সীদের মধ্যে মধ্যবিত্ত পরিবারে বিবাহ- বিচ্ছেদের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
পাঁচ কারণে সমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে বলে এ বিভাগের পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে আসছে। কারণগুলো হলো-যৌতুক, নির্যাতন, প্রতারণা, মাদক সেবন, পরকীয়া ও সন্দেহ। ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার ও মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোনো কিছুই আটকাতে পারছে না এ বিচ্ছেদ। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তবে এখন বদলে গেছে তালাকের ধরণ। আগে ৭০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটতো স্বামী কর্তৃক। এখন মেয়েরা বেশি তালাক দিচ্ছেন।
কেসিসি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়েছে ৯৩২টি, ২০১০ সালে ৯৩৩, ২০১১ সালে ১০৭৪, ২০১২ সালে ১১৮১, ২০১৩ সালে ১২৫৪, ২০১৪ সালে ১৪১৯, ২০১৫ সালে ১৪০৪, ২০১৬ সালে ১৪৮৭, ২০১৭ সালে ১৫৯৫, ২০১৮ সালে ১৭১৯ এবং ২০১৯ সালে ১৭০৬টি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।
করপোরেশনে জমা পড়া তালাকের তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তালাক দেয়া পুরুষের সংখ্যা মাত্র ৩৫ শতাংশ, আর নারীর সংখ্যা ৬৫ শতাংশ।
কেসিসির শালিসি পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিব মো. আজমুল হক ইউএনবিকে বলেন, সমাজে তালাকের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব, নারীদের মধ্যে নির্ভরশীলতা কমা, নারীদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, ব্যক্তিত্বের অভাব, মোবাইলের অপব্যবহার, বেকারত্ব ও যৌতুক। তাই এটি প্রতিরোধে সকলকে সচেতন হতে হবে।
বিশিষ্ট নারী নেত্রী ভাষাসৈনিক বেগম মাজেদা আলী বলেন, নারীদের সচেতনতা বেড়েছে। আগে নির্যাতিত হলে তা মুখ বুঝে সহ্য করত। এখন প্রতিবাদ করে। এখন নারীরা রোজগার করে। স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে। এখন ভালোবাসা-শ্রদ্ধাভক্তি দুটোই কমেছে। এ জন্য সমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে। তবে বিচ্ছেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবাইকে ধৈর্য ধরে ভেবে-চিন্তে সামনে এগোতে হবে। তবেই সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা হ্রাস পাবে বলে এ নারী নেত্রী মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রভাব পড়ছে সন্তানের ওপর। তারা বেড়ে উঠছে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে। যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। এক ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে। তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। সমাজ, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে। পারিবারিক অশান্তি, হতাশা ও অপরাধমূলক কাজের প্রবণতায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরৎ-ই খুদা বলেন, সংসার ভাঙার ঘটনায় নারীদের অগ্রণী ভূমিকার কারণ হচ্ছে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা, স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতা কমা, ফেসবুকের অপব্যবহার, পাবিবারিক সাংস্কৃতি পরিবর্তন। এ সামাজিক ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে হলে যৌতুক আইনের সংস্কারে মত দেন তিনি।
তালাক দেয়ার ক্ষমতা রেজিস্ট্রারের (কাজী) হাত থেকে সরিয়ে আদালতে হস্তান্তর করতে পারলে বিবাহ বিচ্ছেদ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে বলে এ নাগরিক নেতা মনে করেন।
নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট তছলিমা খাতুন ছন্দা বলেন, আগে মেয়েরা মনে করত তালাক মানে তারা সর্বহারা। এখনকার মেয়েরা অধিকাংশই তা মনে করে না। শিক্ষিত নারীদের তালাকের ঘটনাটি বেশি ঘটছে। কারণ শিক্ষিত নারীদের স্বাধীন মানসিকতা আর অধিকাংশ পুরুষ মান্ধাতার আমলের মানসিকতা এখনও ধরে রেখেছে। সে তার মায়ের চলাফেরাকে স্ত্রীর মাঝে দেখতে চায়। এ জন্যই তাদের মধ্যে তালাকের ঘটনা ঘটছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদেরও দোষ কম নয় বলে তিনি দাবি করেন।
সূত্র : ইউএনবি