কিট জালিয়াত চক্রের অভিনব কৌশল

অপরাদ বাংলাদেশ

 

দিগন্তের আলো ডেস্ক :

করোনা, ক্যান্সার, এইডস, জন্ডিস, ডায়াবেটিস, প্রেগনেন্সি ও নিউমোনিয়া রোগের নকল টেস্ট কিট ও নকল ওষুধ তৈরির জালিয়াত চক্রটির ছিল অভিনব কৌশল। ছিল নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ার ও দক্ষ টেকনিশিয়ান। চীন থেকে আনা হতো এসব নকল কিট ও ওষুধ। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জার্মানি ও ইউরোপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি করা হতো অত্যাধুনিক মেডিকেল সামগ্রী। আর তা ব্যবহার করা হতো জালিয়াতির কাজে। তাদের এসব কিট ও মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানির কোনো অনুমোদন ছিল না। বিদেশ থেকে আমদানি-রপ্তানি চ্যানেলের মাধ্যমেই তারা এসব এনেছে। দীর্ঘ এক দশক বা ১০ বছর ধরে ক্যান্সার, এইডস, জন্ডিস, ডায়াবেটিস ও নিউমোনিয়া রোগের টেস্ট কিট ও নকল ওষুধ এবং মেয়াদ বাড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে আসছিল জালিয়াত চক্রটি।
তাদের অপরাধের ধরন দেখে যেকোনো ব্যক্তিরই গা-শিউরে উঠবে। মানুষের জীবন নিয়ে এক প্রকার ছিনিমিনি খেলেছে চক্রটি। গত বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত র?্যাব-২ ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকায় অবস্থিত বায়োল্যাব ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বনানী এলাকায় অবস্থিত এক্সন টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটেড এবং হাইটেক হেলথকেয়ার লিমিটেড নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়। ৪ ট্রাক নকল কিট ও ওষুধ জব্দ করা হয়। ৪ ট্রাকে প্রায় ১২ টন পণ্য জব্দ করা হয়। করোনাভাইরাস, এইচআইভি ও রক্তসহ সব পরীক্ষার রি-এজেন্ট ছিল সেখানে। বেশির ভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ বা টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া কিছু অনুমোদনহীন। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় জালিয়াত চক্রের ৯ সদস্যকে। তাদেরকে ইতিমধ্যে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গত বছর থেকে পৃথিবী ব্যাপী করোনাভাইরাসের আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় জালিয়াত চক্রটি করোনার নকল কিটও সরবরাহ শুরু করে। তারা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালিয়াত চক্রটি ২০১০ সাল থেকে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশ থেকে বিশেষ করে চীন থেকে বিভিন্ন রোগের কিট এনে তা টেম্পারিং করে মেয়াদ বাড়াতো। এই তিন প্রতিষ্ঠান করোনা, ক্যান্সার, এইডস, জন্ডিস, ডায়াবেটিস ও নিউমোনিয়া রোগের টেস্ট কিটের মেয়াদ বাড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতো। তাদের কাছে আছে বিভিন্ন মেডিকেল ডিভাইস। বিশেষ প্রিন্টার। সব কিছুতেই ছিল জালিয়াতি। কোনো কিছুরই ছিল না অনুমোদন। জালিয়াতির জন্য চীন বা অন্য দেশ থেকে আমদানি করতো অত্যাধুনিক মেডিকেল ডিভাইস। এসব করা হতো শুধুই জালিয়াতির জন্য। এর মাধ্যমে করা হতো করোনার নকল টেস্টিং কিট ও রি-এজেন্টসহ অন্যান্য রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন রোগের টেস্টিং কিট ও রি-এজেন্ট। তাদের কাছে সংরক্ষিত কোনো প্রোডাক্টই মেয়াদোত্তীর্ণ হতো না। ইচ্ছামতো বাড়ানো হতো মেয়াদ ও দাম। অনেক ক্ষেত্রে নকল কিট ও ওষুধ পানির দামে কিনে বিক্রি করতো উচ্চ দামে। আর এর মাধ্যমে ফুলে-ফেঁপে উঠছিল জালিয়াত চক্রটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন প্রতিষ্ঠানেরই ছিল বিশেষ ধরনের প্রিন্টিং মেশিন। যার মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার খুব অল্প সময় রয়েছে, এমন বিভিন্ন টেস্টিং কিট ও রি-এজেন্টের মেয়াদ বাড়ানোর কাজ করা হতো। তাদের ওয়্যারহাউজগুলোতে মজুতকৃত বেশির ভাগ মেডিকেল কিট, ওষুধ ও ডিভাইসের অনুমোদন নেই। প্রায় সব ধরনের টেস্ট কিট এবং রি-এজেন্ট ব্যবহারের মেয়াদোত্তীর্ণ অথবা দ্রুতই মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। এমনকি এইডস নির্ণয়ের জন্য নির্ধারিত প্যাথলজিক্যাল টেস্ট কিট ও রি-এজেন্টও রয়েছে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের তালিকায়। এসবও নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের জালিয়াত ব্যবসায় নতুন করে যোগ হয় করোনার টেস্টিং কিট ও অন্যান্য মেডিকেল সরঞ্জাম। যার বেশিরভাগই নকল বা মেয়াদ উত্তীর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে ঠিক কতো মানুষ এসব নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ কিটের মাধ্যমে টেস্ট করিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রতারণায় অভিযুক্ত ৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেবল বেসরকারিতে নয়, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালেও টেস্ট কিটগুলো সরবরাহ করেছে। দেশে কতগুলো হাসপাতালে এবং কী পরিমাণে নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন কিট সরবরাহ করা হয়েছে তার জন্য অনুসন্ধানে নেমেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ইন্টেলিজেন্স টিম। এর আগে গত বছর করোনা টেস্ট সংক্রান্ত জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদ ওরফে শাহেদ করিম এবং জেকেজি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফকে। নতুন করে আটক হওয়া চক্রটির শাহেদ ও সাবরিনার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খোঁজা হচ্ছে এ চক্রের গডফাদারদের। জালিয়াত চক্রটি র‌্যাবের হাতে আটক হলেও বর্তমানে মামলার তদন্ত করছেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই ও মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ দেবাশীষ মোদক। তিনি মানবজমিনকে বলেন, মামলার তদন্ত চলমান। আসামিদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *