দিগন্তের আলো ডেস্ক :
এবারও জামিন পাননি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের ডিভিশন বেঞ্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন। ইতিপূর্বে হাইকোর্ট বিভাগের একই বেঞ্চ এবং আপিল বিভাগ জামিনের আবেদন খারিজ করে দেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে করা এটি ছিল তৃতীয় জামিন আবেদন। দেশের চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে খালেদা জিয়ার পক্ষে এ আবেদনটি করা হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের (উন্নত চিকিৎসা) জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্মতি দিয়েছেন কি-না, সম্মতি দিলে চিকিৎসা শুরু হয়েছে কি-না এবং শুরু হলে সর্বশেষ কি অবস্থা-তা জানাতে বিএসএমএমইউ ভিসিকে নির্দেশ দেন আদালত। ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকালে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর। নির্দেশনা অনুসারে বুধবারেই তার দপ্তরে বিএসএমএমইউ’র মেডিবোর্ডের পাঠানো রিপোর্টটি আসে। হাইকোর্টে জমা দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়. খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসা নিতে সম্মতি দেননি। আদালত প্রতিবেদনটি পাঠ করেন। সকালে আদালতে বিএসএমএমইউর প্রতিবেদন পড়ে শোনান। পরে আদেশের জন্য বিকেলে সময় রাখেন হাইকোর্ট। আদেশে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন হাইকোর্ট।
আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা হাইকোর্ট এনেক্স ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
এর আগে দিনের প্রথমার্ধে খালেদা জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীনসহ সিনিয়র আইনজীবীরা শুনানি করতে যান। শুনানি শেষে আদালত রিটটি খারিজ করে দেবেন- মর্মে জানান। এ সময় আরো শুনানির আবেদন জানান জয়নুল আবেদীন। একই সঙ্গে একটি আরেকটি সম্পূরক আবেদন দিয়ে সেটির ওপর শুনানি করতে চান। এ জন্য আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত সময় চান তিনি। সেটি অগ্রাহ্য করে আদালত বেলা ২টার পর আদেশের জন্য রাখেন। দুপুর সোয়া ২টায় আদালত বসলে সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানি করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীন। এ সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পক্ষান্তরে জামিনের বিরোধিতা করে সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান। এ সময় শুনানির মাঝে উভয় পক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে নানা ধরণের মন্তব্য করেন আদালত।
আদালত স্বাস্থ্যগত কারণে করা জামিন আবেদন খারিজ করে দেয়ার আদেশে হাইকোর্ট বলেন, খালেদা জিয়া একজন দন্ডিত ব্যক্তি। সাধারণ মানুষ আদালত থেকে যে ধরণের সুবিধা পাবেন, দন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে খালেদা জিয়া সেই সুবিধা পাবেন না। সাধারণ মানুষ যেভাবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে একজন বন্দি তা পারবেন না। তার কারাবিধি ও নিয়ম-নীতি অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। এর আগেও খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। এবারের আবেদনে নতুন কিছু নেই। এ কারণে জামিন আবেদনটি খারিজ করা হলো।
আদেশের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) দেশের সেরা হাসপাতাল। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের অন্য হাসপাতাল থেকে রোগীদের এখানে পাঠানো হয়। আর প্রতিবেদনের এমন কথা নেই যে এই বোর্ড খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা দিতে অক্ষম বা বিএসএমএমইউতে এ ধরণের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, খালেদা জিয়া সম্মতি দিলে এ হাসপাতালেই তার চিকিৎসা শুরু হতে পারে। তিনি যদি সম্মতি দেন তাহলে যেন তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। তার চিকিৎসার জন্য গঠিত বোর্ড চাইলে বোর্ডে আরও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানিকালে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসাটি কোনো গতানুগতিক বিষয় নয় বলেই মেডিক্যাল বোর্ড তার কনসার্ন (সম্মতি) নিতে বলেছেন। এ চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, কোনো আসামি যদি পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট একজন ডাক্তারের অধীন চিকিৎসাধীন থাকেন- তিনি দন্ডপ্রাপ্ত হলেও তার ইচ্ছে অনুযায়ী পুরনো ডাক্তারকেই দেখাতে হবে। এটি জেল কোডেই রয়েছে। খালেদা জিয়া ১৫/২০ বছর যুক্তরাজ্যে একজন ডাক্তার দেখাচ্ছেন। এ কারণে এখনো তিনি একই ডাক্তার দেখাতে পান।
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন খালেদা জিয়ার দুটি মেডিক্যাল রিপোর্ট পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে মেডিক্যাল বোর্ড চিকিৎসা দিয়েছে। এ সংক্রান্ত কোনো রিপোর্টে বলা হয়নি যে, তিনি আগের চেয়ে ভালো আছেন। তিনি বলেন, তার ৭ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ বছর দন্ড খাটা হয়েছে। তিনি একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আবারো তার জামিন চাওয়া হয়েছে এবং এ আবেদনটি করা হয়েছে তিনটি নতুন গ্রাউন্ডে। এ গ্রাউন্ডে আদালত জামিন দিতে পারেন। দন্ডিত হওয়ার পরও ভারতে জয় ললিতা এবং পাকিস্তানে নওয়াজ শরীফকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দিয়েছিল দেশ দু’টির আদালত।
এ সময় আদালত বলেন, পাকিস্তানের দৃষ্টান্ত দেবেন না। ওটা আমাদের জানা আছে।
আদালত বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। বার্ধক্যজনিত কারণেই তিনি আগের মতো চলাফেরায় সক্ষম হবেন না। ঝুঁকির কথা বলছেন? চীনে করোনাভাইরাসে তো শত শত মানুুষ মারা যাচ্ছে। তারা কি ঝুঁকিতে নেই? এখানে কি করার আছে?
জয়নুল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়া বিদ্যমান বোর্ডের কাছ থেকে থেকে উন্নত চিকিৎসা নিতে চাইছেন না এটিও জানা দরকার। আমাদের তো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হচ্ছে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ আবেদনে নতুন কিছুই নেই। আদালতকে বিব্রত করার জন্য একই আবেদন বার বার করা হয়েছে। দুুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি খুরশিদ আলম খান বলেন, এ মামলায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত। কোনো অবস্থাতেই জামিন হতে পারে না। পুরনো বিষয়গুলোই তিনি বার বার আবেদনে উল্লেখ করতে হবে।
গতকাল খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে সারাদেশের চোখ ছিল হাইকোর্টের দিকে। এ উপলক্ষে হাইকোর্টে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আদালতের ৫টি প্রবেশদ্বারেই মোতায়েন করা হয়েছিল অতিরিক্ত পুলিশ। আদালত অঙ্গনে বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চের সামনেও (এনেক্স-১৯) ছিল অতিরিক্ত পোশাকী পুলিশ।
এরও আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার পক্ষে জামিন আবেদন করেন অ্যাডভোকেট সগীর হোসেন লিয়ন। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। তবে আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) যদি সম্মতি দেন তাহলে বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী তার উন্নত চিকিৎসার জন্য পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন খালেদা জিয়া। দুদকের আপিলের পর হাইকোর্টে সেটি বেড়ে ১০ বছর হয়। ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়া জামিন আবেদন করেন। সেই আবেদন এখনও আদালতে উপস্থাপন করেননি তার আইনজীবীরা। ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়। ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে মামলাটি করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১২ সালে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে দুদকের পক্ষেই রায় দেন আদালত। মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত অপর তিন আসামি হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, তার তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মরহুম সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।