আজ আছি, কাল থাকবো কি না জানি না

আইন আদালত

দিগন্তের আলো ডেস্ক ঃ-
পেশা সাংবাদিকতা। বন্ধ নেই। খবর পৌঁছে দিতে হবে মানুষের কাছে। সে খবর দেশের গ পেরিয়ে যাবে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। করোনার খবর,প্রতিদিনের আক্রান্তের খবর, মৃত্যুর খবর। ঘরে বসে সময় কাটালে আপনি ভালো থাকবেন, সে খবর সাংবাদিকদের দিতে হয় ঘর থেকে বাইরে গিয়ে, অফিসে এসে। কোথায় কোন এলাকায় সাধারণ মানুষ সমাজিক দূরত্ব ভঙ্গ করে, অপরকে বিপদে ফেলছে ,পাড়া-মহল্লা, জেলা-উপজেলা, নগর থেকে মহানগর ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকদের সে খবর যোগাড় করতে হয়।

জনতার ভীড়ে যেতে হয়, খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেদিন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধা তো জড়িয়ে ধরে কেদেঁ ফেললেন। বললেন, বাজান দুই দিন খাইনা, আমার একটু খাবার ব্যবস্থা করেন। তার কথায় চোখে পানি এসে যায়। গাড়ির পেছনে থাকা চাল থেকে তিন কেজি চাল দিলাম। আমরা যে সব সাংবাদিকরা এখনও কাজে আছি, তাদের প্রত্যেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়তো রয়েছে।

তখন সম্ভবত ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি। ‘এত টুকু আশা’ নামের একটি সিনেমা দেখেছিলাম। নায়ক ছিলেন ফারুক। ফারুক ভাই মানে আকবর শেঠ পাঠান। বর্তমানে ঢাকার গুলশান-বনানী, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সংসদ সদস্য। ওই সিনেমায় সম্ভবত আনিসের কণ্ঠে একটি একটি গান ছিলো। তিনি পত্রিকা বিক্রি করার সময়ে গানটি গেয়েছিলেন ‘প্রতিদিন কত খবর আসে খবরের পাতা ভরে, আমার জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে গেল অগোচরে।’
সংবাদকর্মীদের জীবনটা এমনই। প্রতিদিন মৃত্যূর ঝুকি নিয়ে বাসা থেকে বের হই। বাসায় আতঙ্কে দিন কাটে স্ত্রী-আর মেয়ে দু’টির। সে কি উৎকণ্ঠা। মেয়েরা ফোনে খবর নেয়, বাবা মাস্ক কি পরেছে? হাত ধুয়েছো? মৃত্যুর ভয় কার না আছে? নিজেও আতঙ্কে থাকি। তবুও আসতে হয় অফিসে চাকরি তো। এখন দুর্দিনে অফিসে না আসলে কখনো সুদিন এলে অফিস কেন আমার দায় নেবে। চাকরির ভয়। এটাই মধ্যবিত্তের জীবন।

আমাদের প্রয়াত জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, ‘মধ্যবিত্ত হয়ে জন্ম নেয়ার চেয়ে, ফকির হয়ে জন্মানো ভালো, তা হলে অন্তত ভালো থাকার অভিনয় করতে হয় না।’ যে কোন দুর্যোগ মানেই মহাঝড় বয়ে যায় মধ্যবিত্তের ওপর দিয়ে। বাংলাদেশে আমরা সিংভাগ মধ্যবিত্তের কাতারে। এখন তো করোনার ভয়, করোনা উৎড়ে গেলে শুরু হবে আরেক যুদ্ধ। তা হলো খাবার নিয়ে। মজবুত অর্থনীতির দেশগুলোই এখন ধ্বসে পড়েছে। কি হবে পরিস্থিতি অনুমান করাও মুশকিল। মানুষ বাচেঁ আশায়-ভবিষ্যতের জন্য ভালো আশায়তেই থাতে চাই। ভালো প্রত্যাশা করতে চাই। আজ বেচেঁ আছি, কাল কি হবে জানি না। চার দিকে অনিশ্চয়তা। সবার মাঝে আতঙ্ক।
ধনি-দরিদ্র সবার এক অবস্থা। কারো বিপুল পরিমাণ টাকা থাকলে তিনি বেচেঁ যাবেন এমন গ্যারান্টি নেই। ভরসা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। অন্যদের কথা জানি না, নিজেরটা বলতে পারি, জীবনে অনেক পাপ করেছি। অমার্জনীয় পাপ। এখন বিপদে পড়ে নামাজ আদায় করি, এই বিপদে পড়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া, সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করবেন কি না জানি না। আল্লাহ রাহমানির রাহিম-তিনি অসীম দয়ালু। হয়তো ক্ষমা করবেন, আবার নাও করতে পারেন। তবে ভরসা একমাত্র তিনিই।

কোথাও নিয়মভঙ্গের খবর পাওয়া পেলে সেখানে হাজির হয় পুলিশ, সেনাবাহিনী। তারা ত্রাণের তদারকি করেন। জনতা জড়ো হলো লাইন ধরে দাঁড় করান। সাংবাদিক, পুলিশ, সেনাবাহিনী করোনার মহা-ভয়াবহতার মধ্যেও মাঠে আছেন। এদেরও আগে আরেকটি শ্রেণির থাকার কথা ছিলো তাদের দায়িত্বে। তাদের দায়িত্বটাই ছিলো আসল। কিন্ত না, তারা সবাই নেই। এরা হলেন চিকিৎসক। নিসন্দেহে দেশের মেধাবী সন্তানেরা চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ পান, মেধাবীরাই চিকিৎসক হন। এই মেধাবী সন্তানেরা জাতির এই দুর্দিনে অনেকেই চেম্বারে তালা ঝুলিয়ে, নোটিশ লাগিয়ে হোম কোয়ারেনটাইন করছেন।

ঢাকায় অনেক চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে বন্ধ পেয়েছি। বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক বন্ধুরা জানিয়েছেন চিকিৎসা নেই। বাণিজ্যিক ক্লিনিকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি হাসপাতালে যারা চাকরি করেন, তাদের অনেকে হাসপাতালে যান বটে তবে, অভিযোগ পেয়েছি রোগীদের এড়িয়ে চলেন। আবারো বলছি, এটা কিন্তু সব চিকিৎসকের বেলায় নয়। মানবিক চিকিৎসকও আছেন, ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে চলেছেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ দন্ত চিকিসক বা অর্থপেডিক্স ডাক্তারের কাছে যাবেন না, অথবা যাবেন না চক্ষু চিকিৎসকের কাছে? করোনা উপসর্গ নিয়ে যেতে পারেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের কাছে। এখন দেখছি দন্ত চিকিৎসকও চেম্বার ছেড়েছেন। তা হলে দেশের সাধারণ রোগের চিকিৎসার কি হবে?

বড় বেদনার একটি খবর দেখলাম পত্রিকায়। সুমন চাকমা নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তার ফেসবুকে মৃত্যুর আগে লিখেছেন, আমার করোনা হয়নি, তবে করোনার কারণেই মারা যাবো। সুমন মারা গিয়েছে। তার ছিলো ফুসফুসের অসুখ। নিয়মিত চিকিৎসা চলছিলো। করোনা ঘোষণার পর ডাক্তার পাননি। ডাক্তার চেম্বার বন্ধ রেখে পালিয়েছেন। শেষ গ্রামে ফিরে ফিরে হোমি প্যাথিকের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিলো। করোনায় আক্রান্ত না হয়েও করোনার কারণে মারা গেল একটি সম্ভাবনাময় জীবন।

ভারতের আলীগড়ের একটি খবর দেখলাম। একজন দরিদ্র চা বিক্রেতা দীর্ঘদিন ধরে যক্ষা রোগে ভুগছিলেন। নিজের ওষুধ কেনার ক্ষমতা ছিলো না। হাসপাতাল থেকে পাওয়া ওষুধই ছিলো তার ভরসা। করোনার পর তিনি গত এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক ওষুধ কোনটাই পাননি। সঞ্জয় কুমার নামের ওই চা বিক্রেতা মারা গেছেন যক্ষা রোগে। করোনার ভয়ে এলাকার কোন লোক তার লাশ দাহ্য করতেও এগিয়ে আসেনি। শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রী এবং ছোট ছোট চার মেয়ে পিতার লাশ কাধে করে শ্মশানে নিয়ে গেছেন। নিষ্পাপ মেয়েগুলোর কাধে বাবার লাশ, চোখে অশ্রুধারা ছবিটি ছাপ হয়েছে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায়। হয়তো আলীগড়ের ওই চা বিক্রেতার আশা-পাশের লোকগুলো বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কোন দিন কোন ব্যাধি তাদের ছোঁবে না।

নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে দুনিয়ার মানুষ যেমন শুভ দৃষ্টান্ত রাখছেন আবার অমানবিকার উদাহরণও রেখে যাচ্ছেন। ইতালির একটি খবর দেখলাম করোনা আক্রান্ত এক বৃদ্ধ লোকের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে তাকে বাচাঁনেরা চেষ্টা করা হচ্ছিলো। ঠিক সেই সময়ে ওই ওয়ার্ডে করোনা আক্রান্ত এক যুবককে আনা হয় কিন্ত হাসপাতালে আর অক্স্রিজেন মাস্ক নেই। বৃদ্ধা লোকটি চিকিৎসকে ডেকে বললেন, আমার অক্সিজেনটা খুলে ওই যুবককে দাও। আমি অনেক দিন বেঁচেছি এখন ওর বাঁচার দরকার। অক্সিজেন খুলে নেয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই বৃদ্ধ মারা যান, সেরে ওঠেন ওই যুবক।

করোনা এমন এক রোগ-যার প্রতিশেধক এখনো বের হয়নি,চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা পারেননি। তারা বলছেন, প্রতিনিয়তই প্রায় নিজের চরিত্র বদলাচ্ছে করোনা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কোন কথা সত্য ধরবো তা নিয়ে নিজের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আল্লাহ তায়ালার এক গজব। সে দিন ফোনে একজন আমাকে বলছিলেন, দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন এমন রোগে মৃত্যু না দেয়, মৃত্যু হলে জানাজা পর্যন্ত হবে না। কোথায় দাফন হবে তাও জানতে পারবে না অনেকে। লাশটাও দেখতে পারবে না প্রিয়জন। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই রক্ষা করতে পারেন এমন গজব থেকে। আল্লাহই জানেন কাল কি হবে?

সর্বত্র আতঙ্ক। বাড়িতে বাড়িতে উৎকণ্ঠা। আজ আছি, কাল থাকবো কি না একমাত্র ওপরওলাই জানেন। তারপরও চার দিকে দেখছি, মজুতের হুড়োহুড়ি। একজন বললেন,এক বছরের চাল কিনে রেখেছেন। তিনটি ডিপ ফ্রিজে মাছ,মাংস ভরেছেন। জানতে চাইলাম, তা হলে কি অন্তত এক বছর বেচেঁ থাকার গ্যারিন্ট পেয়েছেন। ভদ্রলোক খুশি হতে পারলেন না। এক বন্ধুবর আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। কোরায়াইটাইনে ছিলেন। না, তার করোনা হয়নি। বছর চারেক আগে একবার ঢাকায় দেখা তার সঙ্গে সে দিন শুনিয়েছিলেন, এ দেশে বসবাস করা যায় না।এত যানজট, এত মানুষ। গুলশানের বাড়িটা বিক্রি করতে এসেছি। ভাবছি আর কোন দিন আসবো না। যা হোক নানা কারনে সেবার বাড়িটা বিক্রি করতে পারেননি। দেশে ফিরে ফোন দিয়েছিলেন। বললেন, আমেরিকায় মৃত্যুর হার অনেক বেশী তাই চলে এলাম। মাস ছয়েকের বাজার করে ঘরে ঢুকেছি আর বের হবো না। নিজ থেকেই বললেন, ভাগ্যিস সে সময়ে বাড়িটা বিক্রি করা যায়নি তা হলে এখন কোথায় যে উঠতাম।

আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনে দেখা এক ভদ্রলোক, বেড়ে উঠেছেন দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে। যে কোনভাবে ঢাকায় এসে অগাধ টাকার মালিক বনে গেছেন। দেখা হলেই গর্ব করে বলতেন, ছেলে-মেয়ে দু’টিকে আমেরিকায় পাঠিয়েছি, ওরা আর দেশে ফিরবে না। ওরা বলছে দেশে ঘরবাড়ি রাখার কোন দরকার নেই,সব বেচেঁ চলে এসো,তাই ভাবছি। আমেরকিায় করোনায় মৃত্যূর মিছিল দেখে-সেদিন ফোন করে খুব কাদঁলেন। বললেন, কি হয় জানি না, সন্তান দু’টি দেশে থাকলে অন্তত এক সঙ্গে মরতে বা বাচঁতে পারতাম।

মানুষ ভাবে এক রকম-ওপরওয়ালার ভাবনা অন্যরকম। জীবন-মৃত্যু একমাত্র তারই হাতে। আমরা বলি বিজ্ঞান এগিয়েছে- আজকের করোনা নামের একটি অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে পরাজিত দুনিয়ার সকল শক্তি। কাজ হচ্ছে না এটমবোমে বা অন্যকোন মারণাস্ত্রে। এর মধ্যেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে খবর পাচ্ছি দরিদ্র মানুষের জন্য পাঠানো ত্রাণ চুরি করছে এক শ্রেণির অসাধু চেয়ারম্যান মেম্বার। র‌্যাব-পুলিশ ও সেনা সদস্যদের হাতে ধরাও পড়েছে কয়েকজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *